রিজেন্ট হাসপাতাল মালিক সাহেদের যত অপকর্ম
রোগীদের করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের পরই বের হয়ে আসতে থাকে হাসপাতালটি মালিক সাহেদ করিমের অপকর্মের ফিরিস্তি।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) জানিয়েছে, কখনো সেনাবাহিনীর অফিসার, কখনো গোয়েন্দা, আবার কখনো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সংশ্লিষ্ট বলে পরিচয় দিয়ে বেড়াতেন সাহেদ। নিজেকে মিডিয়াব্যক্তিত্ব জাহির করে অর্থের বিনিময়ে টকশোতে অংশ নেওয়াও শুরু করেছিলেন তিনি। মূলত প্রতারণা আর ভেলকিবাজিতে সিদ্ধহস্ত তিনি। এমনকি দেশের ভিভিআইপিদের সঙ্গে ছবি তুলে নিজেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে পরিচয় দিতেও কার্পণ্য করতেন না।
‘সেনাবাহিনীর পরিচয়ও দিতেন’
রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদের নামেও আছে বৈচিত্র্য। জাতীয় পরিচয়পত্রে তাঁর নাম সাহেদ করিম থাকলেও একটি মামলায় জেল খেটে বেরিয়েই হয়ে যান মো. সাহেদ। আগে কারো কাছে তিনি ছিলেন মেজর ইফতেখার করিম। কারো কাছে পরিচয় দেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুহাম্মদ শহীদ নামে।
আবার সুযোগ বুঝে কোথাও মেজর, কর্নেল পদবিও ব্যবহার করতেন। এমনকি তিনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের কর্মকর্তা হিসেবেও পরিচয় দিতেন। আবার রাতারাতি হয়ে ওঠেন গণমাধ্যম ব্যাক্তিত্বও।
বুদ্ধিজীবী সাহেদ!
গত চার-পাঁচ বছর ধরে নিজেকে কথিত বুদ্ধিজীবী বা রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে পরিচয় দিতেন তিনি। সেন্টার ফর পলিটিক্যাল রিসার্চ বা রাজনীতি গবেষণা কেন্দ্র নামে একটি প্রতিষ্ঠানও চালাতেন তিনি। এ জন্য গাঁটের টাকা খরচ করে বিভিন্ন টকশোতে অংশ নিতেন বলেও জানা গেছে।
টকশোতে বিরোধী রাজনীতিকদের বিষয়ে বেশি বেশি সমালোচনা করা সাহেদের বিরুদ্ধে একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কথাও শোনা গেছে। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সুবিধা আদায়ের জন্য ‘নতুন কাগজ’ নামে একটি নামসর্বস্ব পত্রিকাও খুলেছেন তিনি। নিজেকে সেই পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে পরিচয় দিতেন। এসবই ছিল তার বিভিন্ন অপকর্ম থেকে নিজেকে বাঁচানোর ঢাল।
‘৩২ মামলার আসামি সাহেদ’
র্যাবের একজন কর্মকর্তা জানান, ২০১০ সালের দিকে সাহেদ ধানমন্ডি এলাকায় বিডিএস কিক ওয়ান এবং কর্মমুখী কর্মসংস্থান সোসাইটি (কেকেএস) নামে দুটি এমএলএম কোম্পানি খুলে গ্রাহকদের কাছ থেকে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। সাহেদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩২টি মামলা খুঁজে পেয়েছেন র্যাব। এর বেশির ভাগই প্রতারণা মামলা। কারণ প্রতারণা করে অর্থ-সম্পদ গড়ে তোলাই ছিল তার মূলকাজ। এ জন্য করোনামহামারি চলাকালেও স্পর্শকাতর একটি বিষয়েও সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতে বিবেকে বাঁধেনি তার।
গ্রামের লোকজন হতবাক
সাহেদের গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা জেলায়। নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা সাহেদ অল্পদিনেই কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তার এই উত্থানের বিষয়ে এলাকাবাসীও হতবাক। যদিও সাতক্ষীরায় তাকে সবাই ‘প্রতারক সাহেদ’ হিসেবেই চেনে। এদিকে রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদের অপকর্ম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। প্রতারণা করাই যার মূল কাজ, সেই ব্যক্তি কীভাবে সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে চলাফেরা করতেন, কীভাবে কথিত বুদ্ধিজীবী সেজে টকশোতে অংশগ্রহণ করতেন, তার প্রমোটার কারা– এসব নিয়েও চলছে আলোচনা।
সাহেদসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা
প্রতারণার দায়ে রিজেন্ট হাসপাতাল ও প্রধান কার্যালয় সিলগালা করে দিয়েছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। সাহেদসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে করা হয়েছে নিয়মিত মামলাও। র্যাব কর্মকর্তা সারোয়ার বিন কাশেম গণমাধ্যমকে জানান, রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার বিষয়ে অভিযোগ পাওয়ার পর তারা বেশ কয়েকদিন ধরে গোয়েন্দা নজরদারি করেন। এরপর সেখানে অভিযান চালানো হয়। এই সাহেদের উত্থানও অনেকটা নাটকীয়ভাবে হয়েছে।
গ্রেপ্তার হয়েও যেভাবে ছাড়া পান সাহেদ
২০১০ সালের দিকে সাহেদ ধানমন্ডি এলাকায় বিডিএস কিক ওয়ান এবং কর্মমুখী কর্মসংস্থান সোসাইটি (কেকেএস) নামে দুটি এমএলএম কোম্পানি খুলে গ্রাহকদের কাছ থেকে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে গা ঢাকা দিলে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা তার বিরুদ্ধে মামলা করেন।
২০১১ সালে প্রতারণা মামলায় সাহেদ একবার গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে দ্রুতই তিনি জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন। এরপর প্রতারণার অর্থ দিয়ে তিনি রিজেন্ট গ্রুপ নামে ব্যবসা শুরু করেন। চালু করেন রিজেন্ট হাসপাতাল। কিন্তু ২০১৪ সালেই এই হাসপাতালের লাইসেন্সর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।