চীনের মহাকাশ কেন্দ্র নিয়ে পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ
চীন তাদের নতুন স্থায়ী মহাকাশ কেন্দ্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ বা মডিউল উৎক্ষেপণের পর বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পশ্চিমা বিশ্বের বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ। তাঁরা আশঙ্কা করছেন, চীনা এই মহাকাশ কেন্দ্র নির্মাণের পেছনে দেশটির গোপন আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে এবং এর ফলে মহাকাশ বিষয়ে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যে নতুন এক ইঁদুর দৌড় সৃষ্টি হতে পারে। সংবাদমাধ্যম এএনআইএ’র বরাত দিয়ে ইয়াহু নিউজ এ খবর জানিয়েছে।
বৈশ্বিক হুমকিবিষয়ক মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগের সাম্প্রতিক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে যে, গণপ্রজাতন্ত্রী চীন (পিএলএ) প্রতিপক্ষের সামরিক অবস্থান ও সক্ষমতা জানতে কৃত্রিম উপগ্রহের ব্যবহার করাসহ বিভিন্ন মহাকাশভিত্তিক পরিষেবাগুলো একীভূত করতে থাকবে। এ ছাড়া বেইজিং মহাকাশে মার্কিন সামর্থ্যের সঙ্গে তাল মেলাতে কিংবা সে সক্ষমতা ছাড়িয়ে ‘সামরিক, অর্থনৈতিক এবং মর্যাদাপূর্ণ সুবিধা’ পাওয়ার লক্ষ্যে মহাকাশে যুক্তরাষ্ট্রের মতো সক্ষমতা অর্জনের জন্য কাজ করছে বলে ওই প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে।
‘বেসামরিক বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য এবং সামরিক মিশনের জন্য চীন এই মহাকাশ কেন্দ্র তৈরি করতে চায়’, বলছেন এশিয়ান মিলিটারি অ্যাফেয়ার্সের সিনিয়র ফেলো রিক ফিশার।
সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, চীন সম্প্রতি তাদের নতুন স্থায়ী মহাকাশ স্টেশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ বা মডিউল উৎক্ষেপণ করেছে। উচ্চাভিলাসী মহাকাশ কর্মসূচিতে এটি চীনের সর্বসাম্প্রতিক পদক্ষেপ।
‘তিয়ানহে’ নামের এই মডিউলে রয়েছে নভোচারীদের থাকার জন্য ঘর। চীনের ওয়েনচাং মহাকাশ উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে ‘লং মার্চ-ফাইভবি’ নামের রকেটের মাধ্যমে এই ‘তিয়ানহে’ মডিউলটি উৎক্ষেপণ করা হয়েছে।
চীন আশা করছে, তাদের নতুন মহাকাশ কেন্দ্রটি ২০২২ সালের মধ্যে চালু হবে।
মহাকাশে এখন একটিই স্পেস স্টেশন আছে— আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন। এই স্টেশন চীনকে ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না।
মহাকাশ অভিযানের ক্ষেত্রে চীন তার কার্যক্রম শুরু করেছে বেশ দেরিতে। ২০০৩ সালে চীন প্রথম তার নভোচারীকে কক্ষপথে পাঠায়। চীন তখন ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের পর মহাকাশ অভিযানের দৌড়ে তৃতীয় দেশ।
এখন পর্যন্ত চীন মহাকাশের কক্ষপথে এর আগে পাঠিয়েছে দুটি স্পেস স্টেশন। তিয়ানগং-১ এবং তিয়ানগং-২ নামের এ দুটি স্টেশনই ছিল পরীক্ষামূলক মহাকাশ স্টেশন। এগুলো ছিল খুবই সাদামাটা ধরনের মডিউল, যেখানে নভোচারীদের অল্প সময় থাকার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল।
বর্তমানের নতুন তিয়ানগং স্টেশনটির ওজন ৬৬ টন এবং এর অনেকগুলো মডিউল রয়েছে। এই স্টেশন কাজ করতে পারবে অন্তত ১০ বছর।
‘তিয়ানহে’ হল এই স্থায়ী তিয়ানগং মহাকাশ স্টেশনের মূল অংশ। এর দৈর্ঘ্য ১৬ দশমিক ৬ মিটার এবং প্রস্থ ৪ দশমিক ২ মিটার।
এই মডিউল মহাকাশ স্টেশনে শক্তি সরবরাহ করবে এবং স্পেস স্টেশনটিকে কক্ষপথে ঘোরাবে। নভোচারীদের থাকার ব্যবস্থা এবং জীবনরক্ষার প্রযুক্তিও থাকবে এই মডিউলে।
চীনের অন্তত আরও এমন দশটি উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে কক্ষপথে স্টেশন তৈরির বাদবাকি প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম পাঠানো হবে। চীন আগামী বছরের মধ্যে এই স্টেশন চালু করার কাজ সম্পন্ন করার পরিকল্পনা করছে। এই স্টেশনটি ৩৪০ থেকে ৪৫০কিলোমিটার দূরত্বে পৃথিবীর কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করবে।
বর্তমানে পৃথিবীর কক্ষপথে প্রদক্ষিণকারী একমাত্র মহাকাশ স্টেশন হলো ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন-আইএসএস। রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপ ও জাপানের সমন্বিত উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল এই স্টেশন। চীনকে এই উদ্যোগে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি।
আইএসএস-এর ২০২৪ সালে অবসর নেওয়ার কথা, অর্থাৎ ওই বছর স্টেশনটির কার্যক্ষমতা ফুরিয়ে যাবে। তখন তিয়ানগং-ই হবে পৃথিবীর কক্ষপথে একমাত্র মহাকাশ স্টেশন।
চীনে বিবিসির সংবাদদাতা স্টিফেন ম্যাকডোনেল বলছেন, চীন তার মহাকাশ কর্মসূচি দেরিতে শুরু করলেও, অন্য দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য এ ক্ষেত্রে দ্রুত এগিয়েছে। এবং মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাও প্রবল।
যুক্তরাষ্ট্র চীনকে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কর্মসূচিতে অংশ নিতে না দেওয়ার পর চীন নিজের মহাকাশ স্টেশন তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে।
তিয়ানগং যখন পুরোপুরি চালু হয়ে যাবে, তখন সেটি বর্তমান আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের চেয়ে আকারে ছোট হলেও, চীনের এই স্টেশনটিই হবে পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা একমাত্র স্পেস ল্যাব।
এ ছাড়া চীন মঙ্গলগ্রহে অভিযান নিয়ে কাজ করছে এবং রাশিয়ার সঙ্গে একযোগে চাঁদে একটি মহাকাশ স্টেশন তৈরির চিন্তাভাবনা করছে।
বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যে স্নায়ু যুদ্ধকালীন মহাকাশ জয়ের দৌড়ের মতো একটা পরিবেশ তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন স্টিফেন ম্যাকডোনেল। তিনি বলেন, তখন সেখানে বৈজ্ঞানিক গবেষণার সুফলের পাশাপাশি বাড়বে অবিশ্বাসের বাতাবরণও।
চীনের ‘মহাকাশ স্বপ্ন’
চীনের মহাকাশ কর্মসূচিবিষয়ক বিশ্লেষক চেন লান বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, স্থায়ী স্পেশ স্টেশন নির্মাণের এই প্রকল্প চীনের জন্য ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’।
‘এটি হবে চীনের বৃহত্তম মহাকাশ সহযোগিতা প্রকল্প। কাজেই এটা খুবই বড় কিছু’, বলেন চেন লান।
চীন তার মহাকাশ কর্মসূচি নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ খোলাখুলিভাবেই বলেছে। মহাকাশ কর্মসূচিতে ব্যাপক অর্থ ঢেলেছে চীন। ২০১৯ সালে চীনই প্রথম চাঁদের সবচেয়ে বেশি ভেতরে নভোচারীবিহীন রোভার নভোযান পাঠিয়েছে।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দেশটির মহাকাশ কর্মসূচিকে সর্বতোভাবে সাহায্য করছেন এবং চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম প্রায়ই দেশটির ‘মহাকাশ স্বপ্নের’ নানা খবর দিয়ে ‘জাতিকে উজ্জীবিত’ করছে।