অনলাইন শিক্ষায় পরীক্ষা পদ্ধতির চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
বর্তমান বিশ্বে অনলাইনে সামেটিভ এক্সাম (মিড বা সেমিস্টার ফাইনাল) নেওয়ার নির্ভরযোগ্য কোনো সিস্টেম এখনো তেমন দৃশ্যমান নয়। উন্নত বিশ্বের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ফরমাল ডিগ্রি দিচ্ছে। অনলাইন এডুকেশন সিস্টেমের ওপর পিএইচডি করার সুবাদে এবং আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান এবং এক্সপার্টদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে একটা সিস্টেম আমি ডিজাইন করেছি, যার নাম মোবাইল এইডেড অনলাইন সামেটিভ এক্সাম (মাউসি)। এটি ব্যবহার করে আমরা এ দেশে খুব ভালোভাবে অনলাইনে প্রচলিত পরীক্ষাগুলো নিতে পারি। দেখুন, উন্নত দেশে বিদ্যুতের সমস্যা নেই, প্রায় সবার পিসি বা ল্যাপটপ আছে, আর সেখানে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট খুবই সহজলভ্য। উন্নত দেশের ভার্সিটিগুলো বেশির ভাগ সময় অনলাইন এক্সামের ক্ষেত্রে প্রক্টরিং সফটওয়্যার, যেমন এক্সামিটি, প্রক্টরিও, প্রক্টর ট্র্যাক ইত্যাদি ব্যবহার করে, যার খরচ পড়ে ১০ থেকে ১৫ ডলার পার এক্সাম পার স্টুডেন্ট, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
আমাদের দেশে প্রত্যন্ত এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেটের কমবেশি সমস্যা আছে, আর খুব কম শিক্ষার্থীর নিজস্ব কম্পিউটার বা ল্যাপটপ আছে। তবে সবার একটি করে স্মার্টফোন আছে এবং বর্তমানে দেশের সব প্রান্তে মোবাইল ইন্টারনেট মোটামুটি অনেক সহজলভ্য। কম্পিউটার-বেজড পরীক্ষা পদ্ধতিতে শুধু দুই-একটা কুইজ নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মূল্যায়ন সম্ভব নয়। আর যদি টেকনিক্যাল সাবজেক্ট যেমন ম্যাথ, ফিজিক্স, আইটির কথা চিন্তা করেন, তবে ছাত্রছাত্রীদের এসব বিষয়ে কম্পিউটারে পরীক্ষা নেওয়া খুবই দুরূহ। এ ছাড়া পরীক্ষাপ্রতি একজন ছাত্রের পক্ষে এক হাজার ২০০ টাকা (১৫ ডলার এক থেকে দুই ঘণ্টার জন্য) দেওয়া সম্ভব নয়। তবে অনেক কানাডা-অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি বিশ্বের অনেক দেশে তাদের স্টাডি সেন্টার করেছে, যা মূলত পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়।
আমার অনলাইন এক্সাম কনসেপ্টটি খুবই সহজ। এখানে শিক্ষার্থীদের লাগবে একটা স্মার্টফোন (ওয়েবক্যাম ও সাউন্ড অ্যানাবল থাকতে হবে), মোবাইল ইন্টারনেট এবং কলম-খাতা, আর কিছু না। তারা বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে পরীক্ষা দিতে পারবে। এক বা একাধিক শিক্ষক বাংলাদেশের যেকোনো জায়গা থেকে একটা ল্যাপটপ বা পিসির মাধ্যমে পরীক্ষা (১৬ থেকে ২৫ শিক্ষার্থী) তদারকি করতে পারবে। ভার্সিটি প্রদত্ত ই-মেইল এবং ফেস অথেনটিকেটের মতো বায়োমেট্রিক টেকনোলজির কারণে পরীক্ষার্থী বাদে অন্য কেউ ইচ্ছে করলেই পরীক্ষা দিতে পারবে না, ফ্রড ডিটেকশন করা সহজ হবে। এ ছাড়া সিস্টেমটিতে রয়েছে স্মার্ট অ্যাটেনডেন্স অ্যাপ (ভূ-অবস্থানসহ), গ্রিড ভিউ, ক্লোজ অবজারভেশন ভিউ, রেকর্ডিং, টাইমস্ট্যাম্প বেজড লগ জেনারেশনসহ অনেক ফিচার। এই সিস্টেমে অসদুপায় অবলম্বন করার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। শিক্ষার্থীদের একসঙ্গে সব প্রশ্ন দেওয়া হয় না এবং উত্তরপত্র ধাপে ধাপে জমা নেওয়া হয়। পরীক্ষার পূর্বে রুম, টেবিল ও খাতা ভালোভাবে দেখে নেওয়া হয়। অন্য কোনো মোবাইল এবং কম্পিউটার ওই রুমে বা টেবিলে রাখা নিষিদ্ধ। শিক্ষার্থীরা মোবাইলের ওয়েবক্যাম ও মাইক্রোফোন ব্যবহার করে সব সময় ভিডিও কনফারেন্সিং, যেমন গুগল মিট বা জুম প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষকের সঙ্গে যুক্ত থাকে। কোনো কারণে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে এক থেকে দুই মিনিটের মধ্যে পুনরায় যুক্ত হতে হবে, অন্যথায় তারা পরীক্ষা চালিয়ে যাবে; কিন্তু পরীক্ষার ওই অংশের জন্য তাকে শ্রেণি শিক্ষকের ইন্টারভিউ ফেস করতে হবে পরে কোনো সুবিধাজনক সময়ে, যার সংখ্যা ক্লাসপ্রতি এক থেকে দুজনের বেশি হবে না। এগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ড হবে, যার ফলে শিক্ষকদের খুঁজতে হবে না, কে কখন ডিসকানেক্ট হচ্ছে, টাইমস্ট্যাম্প বেজড লগ জেনারেশন থেকে সহজে পাওয়া যাবে।
আমি সিস্টেমটি টেস্ট করেছি বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটিতে আমার ইনস্ট্রাকশনাল টেকনোলজি কোর্সের প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীদের ওপর। ৪৯ জনের মধ্যে ৪২ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল এবং সবাই উত্তরপত্র সঠিকভাবে জমা দিয়েছে অনলাইনে পরীক্ষা শেষ হওয়ার দু থেকে তিন মিনিটের মধ্যে। পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে ন্যূনতম জটিলতা নেই, একেবারে সহজ। সফলতার হার ১০০%, তবে সাত শিক্ষার্থী বিভিন্ন কারণে পরীক্ষা দেয়নি। এখানে শিক্ষকদের কোন শিক্ষার্থীর উত্তরপত্র কোনটি, তা খুঁজে দেখার দরকার হবে না, সব সুন্দরভাবে মূল্যায়নের জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রস্তুত থাকবে। আর এ পদ্ধতিতে উনাদের উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে প্রথাগতভাবে খাতা দেখা ও রিপোর্ট তৈরি করতে যে সময় লাগে, তার এক-তৃতীয়াংশ সময় লাগবে। এটা সত্য যে বাংলাদেশের সব জায়গায় মোবাইল নেটওয়ার্ক সমান না, তবে কিছুটা বুদ্ধির পরিচয় দিলে এই সিস্টেমে পরীক্ষা দেওয়া খুবই সহজ। ধরা যাক, আপনি কোনো প্রত্যন্ত এলাকায় আছেন, আপনি যদি টেলিটক সিম ব্যবহার করেন, হয়তো ভালো নেটওয়ার্ক নাও পেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে গ্রামীণ বা রবি অনেক ভালো ফল দেবে বলে আশা করা যায়।
অনলাইন এডুকেশন আমাদের দেশের জন্য আশীর্বাদ হতে পারে, যদি এই সেক্টরে আমরা একটু মনোযোগ দিই। এ ক্ষেত্রে দেশব্যাপী উচ্চগতিসম্পন্ন নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার পাশাপাশি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনলাইন এডুকেশনের প্রতি পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রিপেয়ার্ডনেস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিশেষে আমি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য, সহকর্মীবৃন্দ এবং প্রিয় শিক্ষার্থীদের, যাদের সহযোগিতায় আমি এই প্রজেক্টটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পেরেছি। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে শুধু এটুকুই বলব, তোমরা বাড়িতে নিরাপদে থাকো এবং অনলাইনে পড়াশোনা চালিয়ে যাও।
লেখক : অনলাইন এডুকেশন এক্সপার্ট ও বিভাগীয় প্রধান (ভারপ্রাপ্ত), আইসিটি ও শিক্ষা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ