অযথা আতঙ্ক নয়, স্বাভাবিক সচেতন থাকি
একটি ভাইরাস, তাতে বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক, বাড়ছে মৃত্যু। ঠিকমতো কিছু বুঝে ওঠার আগেই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, অসুস্থ হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে। এমন যখন অবস্থা, তখন করোনাভাইরাস ভয়াবহ আতঙ্কের রূপ ধারণ করেছে। এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করে এর প্রতিকার বা ওষুধের খোঁজ পাননি বিজ্ঞানীরা।
এটুকুতে আতঙ্ক ছাড়া কোনো আশার বাণী উচ্চারিত হয়নি। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে স্থানীয় বিশেষজ্ঞরাও বলছেন না, করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ হলেই নিশ্চিত মৃত্যু। যে ইতালিতে এই রোগ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, সেখানেও মৃত্যুর হার ১০ শতাংশ, যার অর্থ ৯০ শতাংশ মানুষ সুস্থ হচ্ছে। ইতালিতে বয়স্ক মানুষের সংখ্যাধিক্য আরেকটি বড় কারণ বেশি মৃত্যুর।
বাংলাদেশেও অস্তিত্ব মিলেছে করোনাভাইরাসের। সরকারি হিসাবে আক্রান্তের সংখ্যা আজ সোমবার পর্যন্ত ৪৯। মৃত্যু হয়েছে পাঁচজনের।
কিন্তু বড় আতঙ্ক ঘিরে ধরেছে পুরো দেশকে। মানুষ এমন আচরণ করছে, যা স্বাভাবিক নয়। অনেকেই করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে কোনো নিয়ম না মানলেও করোনাভাইরাসে বা সাধারণ রোগে মারা যাওয়া রোগীকেও কবর দিতে বাধা দিচ্ছে, এমনকি হাসপাতাল নির্মাণে প্রতিবাদ করছে। সিলেটে রাস্তায় অসুস্থ হয়ে পড়া ফিনল্যান্ড প্রবাসী একজনকে সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে যায়নি। হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো সাধারণ সর্দি-জ্বর বা অন্য রোগীকেও ফিরিয়ে দিচ্ছে। গোষ্ঠীস্বার্থ, ব্যক্তিস্বার্থের এমন প্রকাশ খুবই ভয়ংকর।
মূলত আতঙ্ক থেকেই মানুষের এই আচরণ। চারদিকে শুধু করোনা আর করোনা। বিশ্বে প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। আজ এই দেশ তো কাল ওই দেশ। প্রায় সব দেশেই লকডাউন নামের এক কঠোর বিধিনিষেধ। বাইরে বেড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা, জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত বন্ধ। হাত ধুতে হবে, মাস্ক পরতে হবে, গলা শুকনো রাখা যাবে না—এমন সব নির্দেশনায় সাধারণ মানুষ দিশেহারা।
কিন্তু এর সবই করা হচ্ছে ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে, আতঙ্ক ছড়াতে নয়। যে চীনে এই ভাইরাস প্রথম আঘাত হেনেছিল, তারা জয়ী হয়েছে লকডাউনের কঠোর নিয়ম মেনেই। উন্নত দেশেও তা-ই হচ্ছে। কিন্তু কোনো দেশের কোথাও হাসপাতাল নির্মাণে বিরোধিতা বা মৃতদের কবর দেওয়ার বিরোধিতার কথা শোনা যায়নি, যা দেখা গেল বাংলাদেশে।
ইতালিসহ আক্রান্ত দেশ থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের অনেকেই নিয়ম মানলেন না। যাঁরা দেশে ছিলেন, তাঁরাও অবহেলা করলেন। জমায়েত, জড়ো না হওয়ার অনুরোধ, মসজিদ ও প্রার্থনাস্থলে না যাওয়ার নির্দেশনা মানলেন খুব কম লোকই। একেই বলে সচেতনতার অভাব। অভাব শিক্ষার। সনদ হাতে থাকলেই শিক্ষিত হওয়া যায় না। সামাজিক শিক্ষারও দরকার হয়। এ মুহূর্তে নিজেকে বিপদ থেকে রক্ষা করার অর্থ যে দেশকে সুরক্ষিত রাখা, এই বোধটাই তৈরি হয়নি অনেকের ভেতরে।
দেশের পুরো চিত্রটি এখনো পরিষ্কার নয়। করোনার ভয়াবহতা ও বিপদ যতটা না উপলব্ধি করছি আমরা, তার চেয়ে বেশি আতঙ্ক ছড়াচ্ছি কি না, সেটা যেমন প্রশ্ন; আবার বেশি অবহেলা করছি কি না, সেটাও বিবেচ্য। আসলে আমাদের মানুষের বড় একটা অংশের মধ্যে বিপদ সম্পর্কে কোনো বস্তুনিষ্ঠ ধারণাই তৈরি হয়নি। হয় আমরা অতি আতঙ্কগ্রস্ত হচ্ছি কিংবা অতি অবহেলা করছি। উভয় ক্ষেত্রেই অবিবেচক হয়ে চারপাশটাকে বিপন্ন করছি।
আসল কথা হলো, করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে নিয়ম মেনে সচেতন হলে ঝুঁকি কম। রোগ নির্ণয় ও চটজলদি চিকিৎসার পাশাপাশি নিজেকে, নিজের পরিবারের সদস্যদের গৃহবন্দি করাতেই মুশকিল আসান। অন্য কোনো উপায় নেই। এ কথাও মনে রাখতে হবে, করোনাভাইরাসকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো অবকাশ নেই।
১৮১৮-১৯ সালের সেই স্প্যানিশ ভাইরাসের একশ বছর পর মানবজাতির সামনে এমন অভূতপূর্ব সংকট উপস্থিত। তিন মাস বয়সের এক প্রাণঘাতী ভাইরাসের সঙ্গে সারা পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত আধুনিক নাগরিক সমাজের অদৃশ্য লড়াই চলছে।
এ থেকে বাঁচতেই সতর্কতা। মৃত্যুর মিছিল দেখে আতঙ্কিত হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন বন্ধ করতে বলছে না কেউ। একটু খোঁজ নিলেই দেখা যায়, যেখানে বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন, হয় সেখানে বয়স্ক ও অসুস্থ মানুষের সংখ্যা বেশি, নয় ডায়াবেটিক, ক্যানসার, কিডনির দুরারোগ্য অসুখ বা অন্য কোনো কারণে তাঁদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম; নয়তো চিকিৎসাব্যবস্থা যথাযথ নেই। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার লক্ষণ দেখা দেয়। সর্দি, কাশি, জ্বর, মাথাব্যথা হয়। তবে তার সঙ্গে থাকে শ্বাসকষ্ট। ভাইরাসটি দ্রুত শ্বাসনালিকে আক্রমণ করে বলেই রোগীর পরিণতি দ্রুত খারাপ হতে থাকে। তাই বাঁচতে হলে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতেই হবে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগই প্রবীণ এবং ডায়াবেটিস, আগে থেকেই শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত। অর্থাৎ এঁদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ছিল কম।
কাজেই মোটামুটি সুস্থ-সবল কম বয়সী থেকে মাঝবয়সী বা প্রৌঢ় মানুষের সাধারণ সতর্কতাটাই জরুরি বেশি। সংগনিরোধ, সতর্কতার মাধ্যমে এই রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠবেই।
লেখক : সাংবাদিক