আগুন ও আমাদের সস্তা জীবন
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট নির্মাণ অগ্নিদগ্ধ মানুষের চিকিৎসায় আমাদের সরকারের বিশেষ নজরের বড় প্রমাণ। দগ্ধ মানুষের চিকিৎসায় এটি এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ হাসপাতাল।
নারায়ণগঞ্জে পশ্চিম তল্লার মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃত মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এ লেখা যখন লিখছি, তখন সেই সংখ্যা ২৭। শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে বায়তুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণে অর্ধশতাধিক মুসল্লি দগ্ধ হয়েছেন। বিস্ফোরণে মসজিদটির ছয়টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) পুড়ে গেছে। তবে শেষ পর্যন্ত জানা গেল, এসি নয়, আগুন লেগেছে গ্যাসের পাইপলাইন থেকে।
যেহেতু সবশেষ ঘটনা, তাই আলোচনা চলছে। মসজিদ কমিটির লোকজন বলছেন, মসজিদের মেঝের নিচ দিয়ে যাওয়া গ্যাসলাইনে লিকেজ থাকার কথা স্থানীয় তিতাস গ্যাস অফিসে জানানো হলেও তারা কাজ করেনি। ৫০ হাজার টাকা ঘুষ না দেওয়ায় করেনি, এমন অভিযোগও করা হয়েছে। তবে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
এখানে বেশ কিছু প্রশ্নও জেগেছে। প্রথম কথা হলো, কেন তিতাস গ্যাসের লাইনের ওপর মসজিদ নির্মাণ হবে? আবার রাতারাতি নিশ্চয়ই এই স্থাপনা নির্মিত হয়নি। তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তারা দেখছেন, মসজিদ নির্মিত হচ্ছে তাদের লাইনের ওপর, তাঁরা কেন বাধা দেননি? মসজিদে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যায়, তাহলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকে মসজিদ কমিটি কেন সতর্ক হলো না?
প্রতিটি স্তরে মানুষের জীবন নিয়ে এই উদাসীনতা আমরা দেখি। একটি করে ঘটনা ঘটে আর আমরা আলোচনা চালাই আরো একটি বড় ঘটনা এসে আমাদের বিষয় পরিবর্তন করে না দেওয়া পর্যন্ত।
বনানীর এফআর টাওয়ার, গুলশান ডিসিসি মার্কেট বা কারওয়ান বাজারের বিএসইসি ভবনসহ অসংখ্য আগুন লাগার ঘটনা। কিছু ধমক, কিছু হুঁশিয়ারি, তারপর সব আবার আগের জায়গায়। নিমতলী, চুড়িহাট্টার কেমিক্যালে আগুন, শত শত মানুষের মৃত্যু। গোটা রাজধানী তথা সারা দেশে রকমারি দাহ্য পদার্থে বিপদের হাতছানিতে যেন পরস্পরকে টেক্কা দেওয়ার প্রতিযোগিতা। পুরান ঢাকা থেকে আজও সরেনি কেমিক্যালের গুদাম।
যদি প্রশ্ন করা হয়, আগুন লাগে কেন? উত্তর আসবে অনেক। কিন্তু আগুন থেকে বাঁচার উপায় কী? এর উত্তর কেউ দেয় না। ইচ্ছাকৃত অনেক আগুন লাগে, যেমন বস্তির আগুন। ভূমি দখলের জিঘাংসায় রাতের অন্ধকারে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় মানুষের বসত। সারা দেশেই আগুন লাগে, সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়, মানুষের জীবন যায়। সবচেয়ে বেশি আগুন লাগে রাজধানী ঢাকায়। কিন্তু এ দেশে, এ শহরে অগ্নিবিধি বলে কিছু নেই।
ঢাকা কেবলই আকাশ ছুঁইছুঁই করছে। কত সুরম্য ভবন। কিন্তু আগুন থেকে বাঁচার জন্য এসব ভবনে নেই কোনো ব্যবস্থা, নেই কোনো সুনির্দিষ্ট বিধি বা আইন। আগুন লেগে গেলে তা নিয়ন্ত্রণে আনার সক্ষমতাও বাড়ছে না সেই গতিতে, যে গতিতে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা বাড়ছে।
আইন চাই, এটা কোনো বিলাসিতা নয়। মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন। বিধির ফাঁক গলে যখন একের পর এক আগুনের ঘটনা ঘটে, তখন বোঝা যায়, উচ্চমানের অগ্নিনিরাপত্তা মানুষের জন্য অনেক জরুরি।
আন্তর্জাতিক মানের বিধি তৈরি হলেও যতক্ষণ প্রশাসন তা প্রয়োগ করতে আন্তরিকভাবে চেষ্টা না করবে, ততক্ষণ সব বিধিই অসার। গ্যাস অফিস বলেন আর বিস্ফোরক অধিদপ্তর, পরিদর্শক দলের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিলেই আর নিয়ম মানার দায় থাকে না; এই অভিজ্ঞতা সর্বস্তরের। পরিদর্শন করার পর দোষ পায়নি, কিন্তু পরে আগুন লেগেছে এমন ঘটনা অসংখ্য।
আমাদের বোধোদয় হোক। ঢাকাসহ অন্য সব শহরের সব বহুতলে, সব প্রতিষ্ঠানে কঠোরভাবে অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ম যেন যথার্থভাবে প্রযুক্ত হয়, তা নিশ্চিত করা প্রশাসনের দায়িত্ব। যারা নিয়ম মানবে না, তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে ব্যবসার অধিকার ছিনিয়ে নিতে হবে। প্রশ্নটি যখন জীবন-মৃত্যুর, তখন ন্যূনতম বিচ্যুতিও সহ্য করা চলে না।
পৌরসভা বা সিটি করপোরেশন হতে ফায়ার সার্ভিস, সবাই যেন সাযুজ্য বজায় রেখে জনপদসমূহের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্রিয় হয়, তা দেখার সময় এখন। দায়িত্ব সরকারের। তাই আশা করছি, নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় টনক নড়ুক। নাগরিক সমাজেরও দায়িত্ব আছে। প্রশাসন তার দায়িত্ব পালন করবে, কিন্তু আমরাও কেবল বিল্ডিং বানিয়েই যাব, নিরাপত্তায় উদাসীন থাকব, তা হতে পারে না।
প্রশাসনিক গাফিলতি দেখলে সরব হতে হবে। আর কোনো প্রাণ যেন দায়িত্বজ্ঞানহীনতার আগুনে দগ্ধ না হয়, তা নিশ্চিত করতেই হবে আমাদের। সাম্প্রতিক বৈরুত বিস্ফোরণ আমরা দেখেছি। অবহেলায়, উদাসীনতায় একটি শহর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমাদের পুরান ঢাকায় কেমিক্যালের স্তূপ কি এতটুকু শঙ্কা জাগায় না?
লেখক : সাংবাদিক