আঠারোর স্পর্ধা
আঠারোর একটা স্পর্ধা আছে, আঠারোর ব্যক্তিত্ব আছে, পরিমিতি আছে। আজ আঠারোয় পা রাখল এনটিভি, যে তার সূচনা থেকে ভালো কিছু করার স্পর্ধা দেখিয়েছে, সমাজে, মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে তার নিজস্বতা ও পরিমিতির প্রকাশ দেখিয়েছে।
রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে সক্রিয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম টেলিভিশন। অনুষ্ঠান বা সংবাদ সব ক্ষেত্রেই দৈনন্দিন সমাজের নানা খুঁটিনাটি মানুষের সামনে নিয়ে আসে টেলিভিশন। কিন্তু তা আনতে হয় একটা শুদ্ধ প্রচেষ্টায়। টেলিভিশন সেই শুদ্ধতম মাধ্যম। শুদ্ধ উচ্চারণ, শুদ্ধ ছবি, শুদ্ধ উপস্থাপনা, শুদ্ধ প্রকাশ। চলমান জীবন, দেশ ও বিশ্বের চিত্র প্রতিদিন টেলিভিশনের পর্দায়। আয়নায় নিজেকে দেখার মতো করে দেশ ও পৃথিবীকে দেখছে মানুষ। টেলিভিশন আসলে কী দেখায় আর কী দেখাবে, এ নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু শুদ্ধতার যে কথা বলছি, এনটিভি সে স্থানে থাকার নিরন্তর চেষ্টা করেছে শুরু থেকে।
এ দেশের প্রথম শুদ্ধতম পর্দা একুশে টেলিভিশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এনটিভির যাত্রা ছিল মানুষের কাছে আবার একুশকে ফিরে পাওয়া। বিটিভি বা অন্য দু-একটি চ্যানেলের মানহীন সংবাদ ও অনুষ্ঠান যখন এ দেশের দর্শককে বিদেশি চ্যানেলের দর্শক বানিয়ে ফেলেছিল, তখন শুদ্ধতম খবর, নাটক, গান আর সংস্কৃতি নিয়ে যাত্রা শুরু করে এনটিভি। আর এ জন্য সবার আগে অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য এনটিভির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ।
একটির পর একটি চ্যানেল এসেছে, এখনো আসছে। কিন্তু কটিই বা পেরেছে একটা স্বাভাবিক মানের কথা মাথায় রাখতে? উৎকর্ষ আর মানের নিরিখে বাংলাদেশের টেলিভিশন পশ্চিমা দেশের সমকক্ষ কেন হবে না? কারণ, প্রযুক্তিগত সব সুবিধাই এখন এ দেশে উপস্থিত। তবে আমাদের গণমাধ্যম যে বিষয়ে সব সময় পশ্চিমা মাধ্যম থেকে আলাদা থাকে, তা হলো আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রাম, অতীত ঐতিহ্য, স্মরণীয় দিন যেমন—একুশে, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, জাতির জনকের জন্ম-মৃত্যুদিন। এ চেতনা অতীতকাতরতা বা অতীতবিলাস নয়, অতীত-ঐতিহ্য ধারণ করে সামনের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার প্রচেষ্টা।
আমাদের অনুষ্ঠানের মান নিয়ে, বিশেষ করে ওপার বাংলার কিছু চ্যানেলের সঙ্গে সব সময় তুলনা করে বিতর্ক করার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু আমরা কি কখনো তুলনা করে দেখেছি, আমাদের চ্যানেলের, বিশেষ করে এনটিভির মতো চ্যানেলের গান আর নাটক কতটা মানোত্তীর্ণ? আজ এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সময় আমি বিশেষভাবে স্মরণ করছি সদ্যপ্রয়াত এনটিভির সাবেক অনুষ্ঠান বিভাগপ্রধান মোস্তফা কামাল সৈয়দকে। তিনি এনটিভির অনুষ্ঠানকে নিজের মতোই পরিপাটি, সৌম্য ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ করে তুলেছিলেন তাঁর শ্রমে আর মেধার মিশ্রণে।
বাংলাদেশে টেলিভিশন সবচেয়ে বেশি আলোচিত সংবাদ ও সংবাদভিত্তিক অনুষ্ঠান নিয়ে। পৃথিবীজুড়ে রকমারি কাণ্ডকারখানা ঘটছে, বিজ্ঞান ক্ষিপ্রগতিতে অগ্রসরমান, নিত্যনতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন, আন্তর্জাতিক আদান-প্রদানের সূত্রে অনেক নতুন নতুন বিষয়ের ভিড়। স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ ব্যস্ত, আন্তর্জাতিক ভূমিকায় এর নাগরিকবৃন্দ অবতীর্ণ, আমাদের তারুণ্য নানা ক্ষেত্রে নব-উদ্ভাবিত প্রযুক্তির প্রয়োগে উৎসাহী।
আমাদের গণমাধ্যম, বিশেষ করে টেলিভিশন কি পারছে সেখানে সক্রিয় হতে? এ প্রশ্নের উত্তর দেবেন গবেষকেরা। তবে এটুকু বলতে পারি, বিভিন্ন সংস্কৃতির ঝাপটা এ দেশের পরিবেশকে সর্বক্ষণ বিচলিত করছে। সাংবাদিকেরা অনেক নতুন বিষয়ের মুখোমুখি হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। তাঁর সার্বক্ষণিক লড়াই নতুন সবকিছু বিনা বিলম্বে দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
গণতন্ত্র অবরুদ্ধ হলে গণমাধ্যম স্বাধীনতা হারায়। আমাদের গণমাধ্যমের নিরন্তর লড়াই এই স্বাধীনতার জন্য। শাসকশ্রেণি চায় পরাধীন মাধ্যম, কারণ নৈরাজ্য, দুর্নীতি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড মানুষের সামনে প্রকাশ হয়ে পড়ে গণমাধ্যমের কারণে। আজকের দিনে বাংলাদেশের মানুষের কাছে তথ্য এবং বিনোদনের প্রধান ভরসা টেলিভিশন সংবাদ। গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করার জন্য সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসতে হবে। টেলিভিশন চ্যানেল মালিকদের সগঠন হয়েছে, তাঁরা ধীরে ধীরে একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছেন। সময়ের দাবি টেলিভিশন সাংবাদিকদের, কর্মীদের ঐক্য। এই ঐক্য অনতিবিলম্বে প্রয়োজন, কারণ এ ছাড়া দুর্বৃত্তদের পদচারণায় সমাজব্যবস্থা বিপন্ন হয়ে পড়বে।
দুর্নীতি দমন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সব ধরনের গণমাধ্যমের সঙ্গে টেলিভিশন সাহসী ভূমিকা পালন করে থাকে। তাৎক্ষণিকতার কারণে টেলিভিশনে তথ্যপ্রবাহের ওপর ক্ষমতাধরদের চাপ অনেক বেশি। কারণে-অকারণে টেলিভিশনকে দোষারোপ করা এক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এমন বাস্তবতায় টেলিভিশন সাংবাদিক ও কর্মীদের কাজ করতে হচ্ছে এক ঝুঁকিপূর্ণ ও বৈরী পরিস্থিতিতে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে বিভাজন নয়, ঐক্য প্রয়োজন। এই ঐক্য গণতন্ত্রের জন্য, মানুষের অধিকারের জন্য, গণমাধ্যমের শুদ্ধতর বিকাশের জন্য।
বিজ্ঞাপনে আধিক্য, অনুষ্ঠানের মান নিয়ে অনেক কথাই হচ্ছে। কিন্তু সত্যি বলতে কি, বাংলাদেশের দর্শক দেশের টেলিভিশনই দেখতে চান। হয়তো তাঁরা পছন্দের কোনো কিছু পাচ্ছেন না। মানুষের সেই চাওয়ার দিকে নজর দিতে হবে আমাদের। আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো প্রায়ই একই ধারার অনুষ্ঠান প্রচার করে আসছে। সন্ধ্যায় প্রায় একই সময়ে সব টিভি চ্যানেলই সংবাদ প্রচার করে। রাতে প্রায় একই সময়ে টক শো অথবা গানের অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। একই সময়ে অধিকাংশ টিভি চ্যানেলে খবর প্রচার হয়, প্রায় একই সময়ে সিনেমা দেখায় প্রতিটি চ্যানেল। এসব থেকে বেরিয়ে বৈচিত্র্য আনতে হবে।
নিজেকে অন্যভাবে দেখছে আজকের নয়া সমাজ। দীর্ঘমেয়াদি ঘটনার পরম্পরা আর সম্পর্কের নিরিখে মানুষের উপলব্ধিতে নতুনত্ব আসছে বারবার। সেই নতুনত্বকে নতুন করেই পর্দার সামনে আনতে হয় টেলিভিশনকে। এনটিভি শুরু থেকে নিজস্ব স্বকীয়তায় এগিয়েছে। আশা করছি, আগামী দিনগুলোতেও শুদ্ধতার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
লেখক : সাংবাদিক