আমার শিক্ষক আমার অনুপ্রেরণা
‘জার্নি বাই বোট’ রচনা কীভাবে লিখতে হবে, ব্যাঙের জীবনচক্র কেমন, শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় আট মণ চাল বা জটিল-সরল অঙ্ক কীভাবে মেলাতে হয়—এমন অসংখ্য বিষয়ে সমৃদ্ধ করে জীবন চলার পথকে সহজ করেছেন যে শিক্ষকেরা, বিশ্ব শিক্ষক দিবসে তাঁদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
আজ আমার প্রিয় দুজন শিক্ষককে নিয়ে লিখছি, যাঁরা আমাকে নিজের ওপর আস্থা রাখা, আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলা, এমনকি স্বপ্ন দেখার সাহস জুগিয়েছেন। তাই তাঁদের বলি ‘অনুপ্রেরণা’।
‘তুমি পারবে’ আর ‘তুমি পারবে না’—এ দুটো লাইন দিয়েই একটি শিশুর ভবিষ্যৎ নির্মাণ বা ধ্বংস করে দেওয়া যেতে পারে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে যশোর শহরতলির পুলেরহাট হাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর আমার শিক্ষক রাজিয়া সুলতানা আমার আত্মবিশ্বাসের সলতেতে যে আলো জ্বেলে দিয়েছিলেন, তা এখনো আমাকে শক্তি জোগায়।
আমি তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। ঢাকায় স্কাউটের একটা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার পর সাভার স্মৃতিসৌধে বেড়াতে গিয়েছিলাম আমরা। সংগত কারণেই ব্যাগটা ভারী। নিতে খানিকটা বেগ পেতে হচ্ছে। আমার চেয়ে সিনিয়র আরেকজন অংশগ্রহণকারী এসে বললেন, ‘তোমার ব্যাগটা ভারী, আমি নিই?’ আমি প্রায় নিমরাজি। আপা বললেন, ‘না, তোমার ব্যাগ তুমিই নাও।’ সেদিন তিনি আমাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার মন্ত্রটা দিয়েছিলেন। মেয়ে বলে একটা ছেলের কাছ থেকে সাহায্য নিতে হবে, নিজেকে দুর্বল ভাবতে হবে, সেই প্রথাগত ধারণাটা ভাঙার শিক্ষাটি তিনি দিয়েছিলেন। পাঁচ বছর ওই স্কুলের শিক্ষার্থী থাকাকালে এমন অসংখ্য ঘটনা আছে, যা আমাকে মানুষ হতে, স্বনির্ভর হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। তখন হয়তো সব বুঝিনি, কিন্তু জীবনের এ পর্যায়ে এসে মনে হয়, রাজিয়া সুলতানার মতো প্রাজ্ঞ শিক্ষক আছেন বলেই আমার মতো অসংখ্য শিক্ষার্থী নিজেকে স্বনির্ভর ও আত্মবিশ্বাসী মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় নিমগ্ন হতে পারে।
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে এইচএসসিতে ভর্তি হয়েছিলাম যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজে। সেখানে আমাদের কম্পিউটার পড়াতেন কাজী ইকবালুর রশীদ, আমাদের সবার প্রিয় শাহীন স্যার। স্যারের কাছে কম্পিউটার শিক্ষার যে হাতেখড়ি পেয়েছিলাম, তা পরে কম্পিউটার চালানোকে সহজ করেছে; কিন্তু স্বপ্ন দেখা বা এগিয়ে যাওয়ার যে শিক্ষা তিনি দিয়েছেন, তাতে ঋদ্ধ হয়েছে জীবন। হাতের লেখা খারাপ বলে সব সময় নম্বর কম পেতাম। বকা যে কত শুনেছি, তার ইয়ত্তা নেই। স্যার পরামর্শ দিলেন, ফাউন্টেন পেন দিয়ে লিখতে। হাতের লেখার কিছু উন্নতি হলো। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর প্রয়োজনীয়তা বুঝে তার জন্য একটা পথ খুঁজে দেওয়ার এই ছোট্ট ঘটনা থেকে কিছুটা হলেও উপলব্ধি করা সম্ভব যে, তিনি শিক্ষার্থীর ভালো-মন্দ নিয়ে কতটা চিন্তা করেন। লেখাপড়া শেষ করে কী হতে চাই, কী করতে চাই, কতটুকু সম্ভব; এসব প্রশ্ন যখন ঘুরপাক খাচ্ছে, তখন স্যার বলেছিলেন, ‘স্বপ্ন দেখো, চেষ্টা করো। তাহলেই সম্ভব। চেষ্টা থাকলেই পারবে।’ কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর শিক্ষাও নিয়েছি। তবু আজও যেকোনো সিদ্ধান্তে, অনুপ্রেরণায় স্যারের কাছে সুপরামর্শ পাই। খুব ছোট থেকে ছোট অর্জনগুলোকে নিয়েও এত উৎসাহিত করেন যে কাজ করার অনুপ্রেরণা কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
কয়েকশ শব্দের মধ্যে হাজারও শিক্ষার্থীকে অনুপ্রাণিত করার যে উদাহরণ তাঁরা তৈরি করেছেন, তা বলে শেষ করা সম্ভব নয়। তবে হৃদয়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য আর ভালোবাসার সবটুকু দিয়ে তাঁদের প্রতি জানাই কৃতজ্ঞতা। আপনারা ভালো থাকুন, এভাবেই অনুপ্রাণিত হোক হাজারও শিক্ষার্থী।