আমি তোমাকে একবার দেখতে চাই বাবা
প্রিয় আব্বা, কেমন আছ তুমি? ১৯৭১ সালে তোমাকে খানসেনারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছিল, মনে পড়ে তোমার? আমার কিছুই মনে পড়ে না। আমি কেবলই লোকমুখে জেনেছি সব। পরিচিতজনদের কাছ থেকে শুনেছি, তখন আমার বয়স ছিল মাত্র নয় মাস। আমার কথা মনে পড়ে তোমার? আমার নাম মনে আছে? আমাকে খুব আদরে কখনো খোঁজার চেষ্টা করেছিলে বাবা?
তুমি এখন কোথায় আছ বাবা? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, তুমি ভালো আছ তো? দেশ স্বাধীন করতে গিয়ে তুমি জীবনদান করলে। সে সময় তোমার আদরের একমাত্র সন্তান মজনুর রহমান জন্ম নিয়েছিল মাত্র, মনে পড়ে তোমার? তুমি শহীদ হওয়ার পরপরই তোমার স্ত্রীও রোগাক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল, তুমি কি সে কথা জানো বাবা? তুমি শহীদের মর্যাদা পেয়ে ভালো আছ বাবা?
আচ্ছা, তোমার সঙ্গে কি কখনো দেখা হবে না আমার? আমাকে কখনো দেখতে ইচ্ছে করে না তোমার? আমার খুব ইচ্ছে করে। আমার খুব কষ্ট হয় বাবা, খানসেনারা তোমার লাশের দাফনও আমার ভিটেতে করতে দেয়নি। তোমাকে দেখার প্রবল ইচ্ছে নিয়ে আমি তোমার কবরের পাশে যাই প্রায়ই। কাঁদি, কিন্তু তোমাকে দেখতে পাই না। অবশ্য মনে হয়, তুমি বোধহয় পাশে আছ। কিন্তু আমার বড় শখ জাগে বাবা, তোমাকে একবার হলেও দেখতে।
আমার খুব একা একা লাগে বাবা। তুমি আর মা দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকেই আমি গ্রামের মানুষের ভালোবাসায় বড় হতে শুরু করি। আমি যাদের আশ্রয়ে বড় হতে শুরু করেছিলাম, সেই স্বার্থান্বেষী মহলের তৎপরতায় তোমার রেখে যাওয়া শত বিঘার ওপরের জমিজমা সব বেহাত হয়েছে। সেসব ইতিহাস জান তুমি? আমি এখনো চেয়ে চেয়ে দেখি, আমার সব সম্পত্তি লোকজনে ভোগদখল করছে। এসব দেখতে পাও তুমি? তোমার কষ্ট হয় না? সব উদ্ধার করতে ইচ্ছে করে না?
তবে আব্বা, এসব নিয়ে আমার খুব একটা আক্ষেপ নেই। বরং কখনো হৃদয় ভরে হেসে উঠি এই ভেবে যে তুমি এ দেশের একজন জনক। আরো ত্রিশ লাখ শহীদসহ অনেক জীবিত মুক্তিযোদ্ধা এই দেশের জনক। যাঁদের জন্য আমরা লাল-সবুজের এক দেশ পেয়েছি। তোমাদের হাতে জন্ম নেওয়া দেশেই আমি জীবনযাপন করি। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে, বলো? আমি আনন্দিত, আমি পুলকিত। আমার চাওয়া শুধু একটাই, মরার পর হলেও আমি তোমাকে একবার দেখতে চাই বাবা।
আচ্ছা আব্বা, তুমি যদি এখন বেঁচে থাকতে আমাদের মঙ্গল চাইতে না? এই দেশের জন্য কি আবারও যুদ্ধ করতে? আমার জীবন তো প্রায় শেষ পর্যায়ে। আমার কাছ থেকে এই দেশ হয়তো আর কিছুই পাবে না। কিন্তু এই দেশের জন্য কিছু করবে এমন মনোভাবে আমি তিন সন্তান জন্ম দিয়েছি। তুমি আমার জন্য না হলেও তোমারই উত্তরসূরিদের জন্য আশীর্বাদ করো। ওদের পাশে থেকে সব সময় সাহস দিও বাবা। ওদেরকে আদর দিও। ওরা কখনো দাদা-দাদির আদর-সোহাগ পায়নি। গোপনে হলেও ওদের ভালোবেসো বাবা।
আজ বিশ্ব বাবা দিবস। তোমাকে আমার খুব মনে পড়ছে বাবা। জীবনে কখনো বাবার আদর পাইনি। অন্য বাবারা যখন তাঁদের সন্তানকে আদর করে তখন আমার খুব আফসোস হয়, কান্না আসে। ভীষণ কষ্ট হয় আমার। তুমি সেই কষ্ট অনুভব করো আব্বা? আমাদের সবার জন্য দোয়া কোরো। এই দেশের জন্য দোয়া কোরো। দেশের মানুষ তোমাদের সম্মান করে স্মরণ করে সব সময়। আমি তোমার অস্তিত্ব হয়ে গর্ববোধ করি বাবা। মরে যাওয়ার পরে হলেও যেন আমি তোমাকে একবার দেখি। আমার শেষ ইচ্ছেটা যেন সৃষ্টিকর্তা পূরণ করেন। তুমি ভালো থেকো বাবা। ভীষণ ভালো থেকো। পিতৃহীন সন্তানের পক্ষ থেকে বাবা দিবসের শুভেচ্ছা নিও। ভালোবাসা নিও।
লেখক : শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মনিরউদ্দীন মণ্ডলের সন্তান