এ শহরে স্বাস্থ্যের সংকট
করোনাভাইরাস আতঙ্কের মধ্যেই শীত আর বসন্ত শেষ হয়ে দুয়ারে প্রস্তুত ডেঙ্গুর মৌসুম। গতবারের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ জানে, এক কঠিন সময় সমাগত। হাসপাতাল থেকে সচিবালয়, ক্লাবঘর থেকে পাড়া-মহল্লায় আবার আলোচনা শুরু হয়েছে—গতবার ডেঙ্গুতে কতজন মারা গেছে আর এবার কী হবে।
কত মানুষ মারা গেছে, কতজন ভুগেছে, কত জেলা-উপজেলায় ছড়িয়েছে, সেই পরিসংখ্যানের চেয়েও বেশি আতঙ্কিত মানুষ; কারণ এত দ্রুত, ব্যাপক ও ঝুঁকিপূর্ণ কোনো রোগের সংক্রমণ এ দেশবাসী বহুদিন ধরে দেখছিল না। কী করে ঢাকায় এমন ভয়ানক আকার নিল ডেঙ্গু এবং তা ছড়িয়ে গেল দেশজুড়ে? উত্তর একটাই, মশা। ঢাকা একসময় মসজিদের শহর বলে পরিচিত ছিল, রিকশার শহর বা যানজটের শহর নামেও পরিচিতি আছে। কিন্তু এ শহর মশার শহর। কোথাও হাঁটা বা বসার উপায় নেই, নাকে-মুখে আক্রমণ শুরু করে শক্তিধর এই ক্ষুদ্র প্রাণী।
ঠিক এই বাস্তবতায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নতুন মেয়র ও কাউন্সিলরদের নির্বাচিত করেছে। নির্বাচন হয়েছে ১ ফেব্রুয়ারি, নবনির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলররা শপথ নিলেন প্রায় একমাস পর এবং দায়িত্ব নেবেন আরো এক মাস যাওয়ার পর।
এর মধ্যেই খারাপ খবর আসতে শুরু করেছে। গেল বছরের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দেখা যাচ্ছে মশার ঘনত্ব। গতবার উত্তরের মেয়র ছিলেন নবাগত আর দক্ষিণের মেয়র ডেঙ্গুর প্রকোপের আগে ও পরে মশা নিধনের চেয়ে বেশি সচেষ্ট ছিলেন জনসাধারণের অজ্ঞানতাকে দোষারোপ করতে।
মশা বাড়ছে এবং বেড়েই চলেছে, সিটি করপোরেশন তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। দুই করপোরেশন মশা মারতে অদক্ষতা দেখিয়েছে, ডেঙ্গুর প্রকোপ থামাতে যখন যা প্রয়োজন ছিল তা করতে বিলম্ব করেছে। আবার এ কথাও সত্য যে, সাধারণ মানুষ, বিশেষত শিক্ষিত মানুষ ডেঙ্গু বিস্তারে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। ফুলদানি, টব, চৌবাচ্চা ইত্যাদিতে স্বচ্ছ পানিতে ডেঙ্গু মশা এডিস বংশবিস্তার করে, এটা জেনেও সচেতন হয়নি মানুষ। আরেকটি বড় কারণ হলো, শহরজুড়ে এয়ার কন্ডিশন্ডন ভবনের বিস্তার, নানা ধরনের উন্নয়নকাণ্ডের জন্য খানাখন্দকে পানি জমে থাকা, থানাসমূহে পুরোনো গাড়িতে স্বচ্ছ পানির আধার সৃষ্টি হওয়া, ইত্যাদি নানাবিধ কারণ এ বছরও বিরাজমান।
এই শহরে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা এত দুর্বল যে মশার বংশবৃদ্ধি ঘটবেই। বলা হতো, ডেঙ্গু মূলত শহুরে অসুখ। নগরায়ণের ফলে শৌচাগার ও নিষ্কাশনব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে শহরের আনাচে-কানাচে এই রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু গতবার এটি ছড়িয়েছে সারা দেশে। কারণ নগরায়ণের ধাক্কা এখন বড় শহরের বাইরেও চলছে।
অসুখটা যখন এসেই গেল, তখন আমরা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তোড়জোড় দেখেছি। কিন্তু সচেতন হতে হতো আগে থেকেই। নতুন মেয়রগণ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পাননি। কিন্তু কাজটা শুরু করতে পারেন এখনই। এখন ভালো সময়, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর কাজটি করার জন্য। এটি বড় অবদান রাখবে। আমরা জানি, অবকাঠামোর দুর্বলতা আছে, বরাদ্দ অর্থ ও কর্মীর অভাবও স্পষ্ট। করপোরেশনের স্বাস্থ্যকর্মীর অপ্রতুলতাও আমাদের জানা। তাই রোগের নিয়মিত নজরদারি-পরিদর্শন বলতে যা বোঝায়, তার প্রায় কিছুই হয় না। রোগ এসে গেলে মূল মনোযোগ চলে যাবে চিকিৎসার ওপর। তাই আগেভাগেই তৈরি হতে হবে।
নির্বাচনের সময় অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তাঁরা। এই শহরকে সিঙ্গাপুর করে ফেলার মতো প্রতিশ্রুতিও কম আসেনি। কিন্তু মানুষ সিঙ্গাপুর বা ব্যাংকক চায় না, মানুষ চায় ঢাকা ঢাকার মতোই একটু বাসযোগ্য হোক। রোগ প্রতিরোধ, উন্নত পানীয় জল ও শৌচাগারের ব্যবস্থা, ময়লা সাফ রাখা, দূষণ নিয়ন্ত্রণের মতো জনস্বাস্থ্যের কাজ মেয়রদের কাছে জরুরি হয়ে উঠুক।
দুটি মৌলিক কাজ—মশা নিধন আর আবর্জনা পরিষ্কার ভালোভাবে করতেই হবে। এখানেই প্রত্যাশা বেশি মানুষের। গতবার ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা যখন ভেঙে পড়ল, তখন আমরা দেখেছি করপোরেশনের আসল ভরসা গিয়ে দাঁড়াল বর্ষার ওপর। দুই মেয়রসহ কর্তাব্যক্তিরা বুঝতে পারছিলেন এ ছাড়া ডেঙ্গু কমানোর উপায় নেই। অনেক কথা বলে বলে নাগরিক সমাজকে একটা সময় চুপ হয়ে যেতে হয়েছে।
আমরা জানতেই পারিনি কেন তাঁরা মশা মারতে পারলেন না সময়মতো, তাঁদের কর্মীরা আসলেই ঠিকমতো কাজ করেছে কি না, মশার ওষুধ নিয়ে কত বিতর্কই না হলো, কিন্তু বিষয়টা আজও ধোঁয়াশাই রয়ে গেল। কত বরাদ্দ ছিল আর কত খরচ হয়েছে, কী ফল হয়েছে সে খরচের, সেসব কিছুই জানতে পারিনি।
নতুন দুই মেয়র এবার একটু ভালো পরিকল্পনা করুন, যেন সুসংহতির অভাব না থাকে। নাগরিক সমাজের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি যেন না হয়। এগুলোর সংযোগে কী মারাত্মক ফল ফলতে পারে, গতবারের ডেঙ্গু সেই প্রমাণ দিয়ে গেছে।