করোনার দাপটে নাকাল জনজীবন
নভেল করোনাভাইরাস সৃষ্ট কোভিড-১৯ এরই মধ্যে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। একজনের মৃত্যুর খবরে জনজীবনে নেমে এসেছে অস্থিরতা। মারা যাওয়া ব্যক্তি বিদেশ থেকে আসা ও সংক্রমিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে আক্রান্ত হয়েছিলেন। করোনাভাইরাসে আতঙ্কিত হবেন না, সতর্ক হোন—এ কথা ঠিকই বলছি আমরা, কিন্তু আতঙ্কিত না হয়ে উপায় কী? আমরা কি প্রস্তুত করোনার হিংস্র থাবাকে প্রতিহত করতে?
হৃদরোগীরা ভয় পাবেন না
যে ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে, তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলেন। সত্তর বছরের ওই ব্যক্তির করোনারি ধমনিতে স্টেন্ট পরানো ছিল। এতে করে অনেকে হৃদরোগী ভয় পেয়েছেন। আমার চেম্বারে বেশ কয়েকজন রোগী তাঁদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তাঁদের বলি, হৃদরোগী হলেই করোনায় আক্রান্ত হবেন, এ কথা ঠিক নয়; তবে হলে জটিলতা বেশি। তাই সাবধান থাকবেন।
করোনা নিয়ে মজা করবেন না
যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় করোনাভাইরাস নিয়ে ও এর প্রভাব নিয়ে মজা করছেন, তাঁদের প্রতি বিনীত অনুরোধ, করোনাকে করুণাও করবেন না, মজাও করবেন না।
কেউ কেউ কোভিড-১৯ পুরস্কারবিষয়ক রম্য স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। আমি ছোট্ট একটি সত্য ঘটনা বলি। বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রমণের প্রথম বছর। আমাদের এক শিক্ষক চিকিৎসকের ইন্টারভিউ দেখলাম রাত ১০টার নিউজে। তিনি বলছেন, ডেঙ্গু কোনো ভীতিকর রোগ নয়, এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই (অথচ সে বছর ডেঙ্গুতে বেশ কজনের মৃত্যু হয়েছিল)। যা হোক সকালে হাসপাতালে গিয়ে দেখি, স্যার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ডেঙ্গু নিয়ে। সেই রাতেই ২টার দিকে জরুরি বিভাগে আসতে হয়েছিল।
কোয়ারেন্টিন বনাম আইসোলেশন
এ দুটি শব্দ অনেকের কাছে নতুন মনে হলেও দুটি শব্দই অনেক পুরোনো। মহামারি এলেই এদের আগমনী গান শোনা যায়। ফেসবুকে দেখলাম স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে কোয়ারেন্টিনে। এই নিউজ দেখে এক প্রবাসী দম্পতিও ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন কোয়ারেন্টিনে যাওয়ার। চায়ের কাপে ঝড় বইছে এ দুটি শব্দের ব্যাখ্যা বোঝানোর জন্য। আবার অনেকেই এপিডেমিওলোজিস্ট না হলেও মাস্টার হয়ে গেছেন!
তবে কোয়ারেন্টিনে থেকেও অনেকে আইন মানছেন না। তাই বাধ্য হয়েই জেল-জরিমানা।
শুধু বাঙালি নয়, বিদেশেও অনেকে জরিমানা গুনছেন আইন অমান্য করে। তাই বিনীত নিবেদন, যদি কোভিড-১৯ বা করোনার উপসর্গ থাকে, তাহলে অবশ্যই আইসোলেশনে যাবেন। অতিসত্বর আইইডিসিআর-এর হটলাইনে যোগাযোগ করুন। যদি উপসর্গ না থাকে কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ, বিদেশ থেকে সদ্য দেশে এসেছেন বা এ রোগ থাকতে পারে এরূপ তীব্র সন্দেহের অবকাশ থাকলে তাঁকে কিছুদিনের জন্য পৃথক রাখা দরকার। তবে কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় আপনার মোবাইল ফোনটি আপনার সঙ্গী হিসেবে থাকতে পারবে। এ সময়ে একটি রুমে আলাদা থাকতে হবে, যাতে করে পরিবার-জাতি সুরক্ষা পায়। কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তির ব্যবহার্য তোয়ালে, টিস্যু পেপার, রুমাল একটি নির্দিষ্ট স্থানে রেখে পরে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আরো অনেক কথা আছে কোয়ারেন্টিন আর আইসোলেশন নিয়ে। শুধু সরকারই এখন কঠোর হচ্ছে না, সাধারণ মানুষও জেগে উঠছেন এই ইস্যুতে। ইতোমধ্যে খবরে এসেছে, কোয়ারেন্টিন না মানায় বাবার বিরুদ্ধে ছেলে অভিযোগ করেছে।
করোনায় কিট ইস্যু
করোনায় কুপোকাত জনজীবন। ইতোমধ্যে ১৭ জন, কয়েক দিন পর কী হবে। যখন উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব-পশ্চিম থেকে ঘিরে ধরবে? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, টেস্ট টেস্ট টেস্ট। আর আমাদের এ কয়টি কিট দিয়ে কী হবে। যুদ্ধকালে এত কম অস্ত্র দিয়ে কী হবে? আমরা এখন পর্যন্ত যে নিয়মে ভাইরাস শনাক্ত করছি, তার নাম পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (পিসিআর)। এটি অত্যন্ত কার্যকর পদ্ধতি ভাইরাস শনাক্তকরণের। কিন্তু এটি সময়সাপেক্ষ আর ব্যয়বহুল। মুখগহ্বর বা নাসারন্ধ্রের লালা পরীক্ষা করে এই পরীক্ষা শুধু আইইডিসিআরে সম্ভব।
কিন্তু এখন সময় হয়েছে র্যাপিড কিট চ্যালেঞ্জ নেওয়ার। মাত্র দশ মিনিটে করোনা ভাইরাস শনাক্ত করতে পারে এই কিট, যা এখন সময়ের দাবি। যদিও সেনসিটিভিটি শতকরা ৯৫ ভাগ। চীন থেকে আনা এ কিট যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও আফ্রিকার কিছু দেশ ব্যবহার করছে। এখানে তেমনটা করা হলে বাংলাদেশের সব জেলা-উপজেলা লেভেলে এই পরীক্ষা করা সম্ভব হবে। সবাইকে ঢাকাও আসতে হবে না। অত্যন্ত কম খরচে মাত্র ৩৫০ থেকে ১০০০ টাকায় পরীক্ষা করা সম্ভব হবে। এমনকি কোয়ারেন্টিনে যাঁরা থাকবেন, তাঁরাও টেস্ট করে নিজেকে মূল্যায়ন করতে পারবেন। তবে এ ব্যাপারে সরকারের কড়া নজরদারি প্রয়োজন। নইলে অনেকে অসাধু ব্যবসায়ে জড়াতে পারে। প্রয়োজনে টাস্কফোর্সের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।
করোনার সাম্যবাদ
বিনা পাসপোর্টে বিনা ভিসায় নভেল করোনার ১৭০টির বেশি দেশে বেড়ানো হয়ে গেছে। বিশ্বনেতৃবৃন্দ থেকে বিখ্যাত তারকা, অজ্ঞাত নাম-গোত্রহীন কেউ বাদ যায়নি। নারী-শিশু-বৃদ্ধ সবাই করোনার শিকার। বলা যায়, করোনার কারণে পুরো বিশ্ব এক ভাষা এক দেশে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। মার্কিন-ইরান যুদ্ধের দামামাও বন্ধ হয়ে গেছে। করোনা ধনী দেশ গরিব দেশ সবাইকেই সমানতালে সামলাচ্ছে। যেসব দেশের জনগণ সারা বছর হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলেন, তাঁদের যেমন ধরেছে; আবার এর উল্টোপিঠও দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশেও শেষ পর্যন্ত কী হয়, সেটা দেখার অপেক্ষায় রইলাম।
করোনা ও খাদ্য গুদামজাত
করোনার ভয়ে পয়সা দিয়ে খাদ্য কিনে গুদামজাত করার দৃশ্য দেখে আমি রীতিমতো অবাক। যিনি এ ভিডিও ক্লিপটি সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করেছেন, তিনিও লিখেছেন ক্যাপশনে, ‘এরাই আসল ভাইরাস।’ যদি সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়, তখন কী হবে? তবে অনেক শহর জাদুর শহরের মতো ভূতের শহরে রূপ নিয়েছে ইতোমধ্যে। হবেই বা না কেন? গতকাল ঢাকায় একটি সুপারস্টোরে গেলে দেখতে পাই, একজন জোরে জোরে বলছেন—একটু পর কিছু পাবেন না, যা কেনার কিনে ফেলেন। কিন্তু কাউকেই এ অপপ্রচারে শামিল হতে দেখিনি।
কোভিড-১৯ মহামারিতে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীদের ভবিষ্যৎ
পারসোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্টের যৌক্তিক ব্যবহার প্রয়োজন, নতুবা সামনের দিনগুলোতে কী হবে জানি না। মানুষের প্রাণ বাঁচাতে নিজের প্রাণদান, প্রতিটি মহামারিতে এ এক হৃদয়বিদারক চিরন্তন সত্য। ইতিহাসের বড় শিক্ষা, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নিই না।
করোনায় অর্থনীতি
শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। এয়ারলাইনগুলো ভীষণ ক্ষতির সম্মুখীন। মাঠের খেলা বন্ধ। করোনার কারণে চাকরি হারাবেন অনেক মানুষ। সারা বিশ্বেই এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। শেষ পর্যন্ত কী হয় অর্থনীতির, সেটাই দেখার বিষয়।
রাখে আল্লাহ মারে কে
এ ছাড়া উপায় নেই। পৃথিবীর অনেক দেশেই করপোরেট অফিস বন্ধ করে দিয়েছে। বাড়িতে বসে অনলাইন অফিস করছে। চিকিৎসা দিচ্ছে। আমরা প্রতি রাতেই বিয়ের দাওয়াত খাচ্ছি! গণপরিবহনের ভিড়ে এখনো ত্রাহি অবস্থা। আল্লাহ না বাঁচালে রক্ষা নেই।
লেখক : মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়