খেলাবান্ধব বাজেট দিয়ে আসুক পরিবর্তন
দেশের গণমাধ্যমের প্রায় ৮০ শতাংশ জায়গাজুড়ে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত খবর। বিশ্ব এখন করোনাভাইরাস মোকাবিলা করছে। মোটামুটি সব দেশের চিত্র একই। লকডাউনে ঘরে অবস্থান করছে মানুষ, আগের চেয়ে বেশি স্বাস্থ্য সচেতন হয়েছে। গণমাধ্যমে স্বাস্থ্যবিষয়ক খবরের এত চাহিদা ও দাপুটে অবস্থান আগে নজরে পড়েনি। অপরাধ, রাজনীতি, বিনোদন আর খেলার সংবাদের ভিড়ে স্বাস্থ্য খাতবিষয়ক বা স্বাস্থ্যবিষয়ক সংবাদগুলো খুঁজে পাওয়াই ছিল মুশকিল। এ ক্ষেত্রে সংবাদের অভাব যেমন আছে, তেমনি নিউজরুমের পক্ষপাতিত্বও আছে। পাঠক ‘খাবে’ তত্ত্বে অপরাধ, রাজনীতি, বিনোদন ও খেলা যত জনপ্রিয়, স্বাস্থ্য খাত তত না। এটাই বাস্তব। দেশের বাজেটেও স্বাস্থ্য খাতকে পেছনেই থাকতে হয়েছে। যথাযথ বরাদ্দ নেই, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যতটুকু রাখার কথা বলছে ততটুকুও নেই। তবে আশার কথা, সরকার আসন্ন বাজেটে স্বাস্থ্য খাতকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা জানিয়েছে।
স্বাস্থ্য মানেই চিকিৎসা না
স্বাস্থ্য মানেই চিকিৎসাব্যবস্থা না। স্বাস্থ্যের ধারণাটি বিশাল ও ব্যাপক। এর সঙ্গে জড়িত মানুষের আর্থসামাজিক ও মানসিক অবস্থা। স্বাস্থ্য খাত নিয়ে কিছু করতে গেলে ওই তিনটি বিষয়ের সমন্বয় প্রয়োজন। স্বাস্থ্যখাতের পাশাপাশি ক্রীড়াখাতও অবহেলিত থেকেছে বছরের পর বছর। দুই খাতই পরস্পরের সঙ্গে বেশ ভালোভাবে জড়িত। সুস্বাস্থ্যের জন্যই খেলাধুলা জরুরি। আর স্বাস্থ্য ঠিক থাকলে পেশাদার খেলা বেরিয়ে আসে। স্বাস্থ্য ঠিক রাখা আর খেলে যাওয়ার সঙ্গে জীবিকার প্রশ্ন আসে। আর সেখানেই প্রশ্ন আসে, এই জরুরি খাতগুলোকে বাজেটে কতটুকু অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
কোথায় সেই অর্জন
ক্রিকেট নিয়ে পরে আলাপ করছি। ফুটবল, অ্যাথলেটিকস, হকি, সাঁতার—এসব ক্রীড়ায় বাংলাদেশের অবস্থান কেমন? অলিম্পিক, কমনওয়েলথ তো দূরের কথা, সাফ পর্যায়ে বাংলাদেশের অবস্থান এখনো বেশ নাজুক। ভারত অলিম্পিককে টার্গেট করে দল তৈরি করে সারা বছর। অথচ দেশের অ্যাথলেটদের অবস্থা শোচনীয়। নিজেদের মেধা ও ভালোবাসার কারণে অ্যাথলেটরা জাতীয় পর্যায়ে খেলতে পারে। অথচ এসব অ্যাথলেটের নেই সম্মানজনক আর্থিক সংস্থান। পাকিস্তান আমলে দ্রুততম মানবী হয়েছিলেন স্প্রিন্টার সুফিয়া খাতুন। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অবহেলার মধ্যে থেকেও বাঙালি নারী বয়ে এনেছেন সম্মান। স্বাধীনতার পর দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে দাপট দেখিয়েছেন শাহ আলম, মাহবুবুল আলম, গোলাম আম্বিয়া, বিমল চন্দ্র তরফদার। এখন অ্যাথলেটিকসে বাংলাদেশ ধুঁকছে। নতুন প্রজন্ম আসছে না। অথচ সম্ভাবনাময় এই খাতে বিনিয়োগ হলে বিশ্বে সুনাম অর্জন করতে পারত বাংলাদেশ।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে সাঁতারুর তো অভাব হওয়ার কথা নয়। আশির দশকে দেশের সাঁতারুরা সাফ পর্যায়ে মাতিয়েছে বেশ। এখন ভারত-শ্রীলঙ্কার কাছে ধরাশায়ী হতে হয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অর্জনও সীমিত। ফুটবলের কথা উল্লেখ করব না। এটা সবাই জানে। দেশে আশির দশকের ফুটবল আর এখনকার ফুটবলের মানের যে বিশাল পার্থক্য, সেটা অজানা নয়। অথচ ফুটবলের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্ঠ। মেধা আছে। প্রয়োজন সে মেধার অনুসন্ধান আর লালন-পালন। আর সেই লালন-পালনের জন্য প্রয়োজন বাজেট। হকি, বাস্কেটবল, শ্যুটিং—সব ধরনের খেলায় একই কথা। প্রয়োজন বাজেট, যাতে এসব খেলাকে পেশা হিসেবে নিতে তরুণ প্রজন্ম আগ্রহী হয়। তবেই দেশের জন্য কিছু করে দেখানোর জন্য মুখিয়ে থাকবে তারা। দেশে ক্রিকেটের এখন রমরমা অবস্থা। কিন্তু সেটা ধরে রাখতেও প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। আশির দশকে দেশে এমনই রমরমা ছিল ফুটবল। অথচ পরিকল্পনার অভাবে এখন করুণ দশা।
মাদক নির্মূলের বাজেট চাই
তৃণমূল পর্যায় থেকে সব পর্যায়ে মাদক নির্মূল করতে হবে। মাদকই ধ্বংস করছে যুবসমাজকে। আইন-কানুন দিয়েও মাদকের কালো হাত থেকে রক্ষা পেতে বেগ পেতে হচ্ছে দেশকে। বিশেষ করে ইয়াবার গ্রাসে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে যুবসমাজ, যার প্রভাব পড়ছে সব ক্ষেত্রে; সেটা খেলা হোক আর শিক্ষা। মাদক নির্মূলের জন্য প্রয়োজনে বাজেটে বরাদ্দ রাখা যেতে পারে। বিষয়টি গুরুত্বসহ আমলে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা উচিত। ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক নির্মূলে যথাযথ বাজেট বরাদ্দ থাকলে তা কার্যকর হবে দ্রুত। বিষয়টি নিয়ে এখন জোর দাবি তোলা জরুরি। বাজেট পেশের সময় এলে বিভিন্ন খাত নিয়ে আলোচনা ও দাবিতে মুখর থাকে নানা শ্রেণি, অথচ মাদক নির্মূলের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যায়।
স্বাস্থ্যবান, মাদকমুক্ত, খেলাবান্ধব একটি তরুণ সমাজ গড়ে তোলার দিকে পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। স্বাস্থ্য ঠিক থাকলে, খেলাধুলা ভালোবাসলে মাদকের প্রতি মোহ থাকে না। বরং খেলাধুলাকে গুরুত্বসহ নিলে দেশের জন্যও সম্মান বয়ে আনা যায়। এতটুকু বাস্তবায়নে খুব বড় বাজেট যে প্রয়োজন, তা নয়। কিন্তু ফলাফল হিসেবে যা আসবে, তা আকাশের চেয়েও বড়।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী