চীন-ভারত যুদ্ধ কি অনিবার্য?
করোনাভাইরাস মহামারিতে সারা বিশ্ব যখন ব্যস্ত, তখন লাদাখ সীমান্ত ঘিরে চীন-ভারত উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। এ দুটি দেশের উত্তেজনা নতুন কিছু নয়। তবে এই মুহূর্তের উত্তেজনার সঙ্গে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যায়। বিশ্বের বর্তমান মহামারি অবস্থায় এমন উত্তেজনা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত মনে করা যায় না। তার পরও লাদাখ সীমান্ত ঘিরে চীন-ভারত যে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে, তা আগামীতে বড় ধরনের সংকটের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করা যায়। এরই মধ্যে ওই সীমান্তে যুদ্ধবিমান ও সাঁজোয়া যানসহ অতিরিক্ত পাঁচ হাজার সৈন্য মোতায়েন করেছে চীন। একইভাবে সৈন্য বাড়াচ্ছে ভারতও। নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর পূর্ব লাদাখের কাছে একাধিক জায়গায় মুখোমুখি ভারত-চীন। মূলত উত্তর, পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত-বিরোধ দীর্ঘদিনের। প্রতিবেশীদের সঙ্গে পাঁচটি যুদ্ধও ভারতকে লড়তে হয়েছে দেশভাগের সময় থেকে।
বর্তমান এই উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিষয় মাথায় আসা স্বাভাবিক, করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের চালচিত্র নতুন করে আঁকার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তা চীন-ভারতের এই উত্তেজনাকর যুদ্ধময় টানাপড়েন এক ধরনের অশনি সংকেত হিসেবে আবির্ভাব ঘটবে। বেশ কিছু কারণে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে চীন বিচলিত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য দ্বন্দ্বে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ক্রমেই জড়িয়ে পড়ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও রাশিয়া অস্বস্তিতে। কিছু বহুজাতিক সংস্থা চীন থেকে কারবার গোটানোর কথা জানিয়েছে। ভারত ‘গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন’-এর অংশীদার হতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি ‘স্বনির্ভর ভারত’ গড়ার ডাক দিয়েছেন। ভারতে নতুনভাবে চীনা পণ্য বয়কটের ডাক শোনা যাচ্ছে। করোনার উৎস তদন্ত ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় তাইওয়ানকে আবার পর্যবেক্ষকের দায়িত্বে নিয়ে আসতেও ভারত আগ্রহী। দৃশ্যত বিচলিত চীনের বর্তমান এই অবস্থান ভারতবিরোধী করে তুলেছে। সার্বিকভাবে বলা যেতে পারে, এটি চীনের পক্ষ থেকে এক ধরনের হুঁশিয়ারি বার্তা। ফলে স্বাভাবিকভাবে আমাদের সবার কাছে এটাই মনে হবে, সীমান্ত-বিরোধ খুঁচিয়ে ভারতকে সংযত রাখার কৌশল হতে পারে চীনের।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না চীন ও ভারত বড় ধরনের কোনো যুদ্ধে নামবে। তবে ২০১৭ সাল থেকে হয়ে আসা ক্রমবর্ধমান সংকটটি বর্তমানে এক মারাত্মক লড়াইয়ে পরিণত হতে যাচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে সর্বাধিক দুর্গম এবং দূরবর্তী সীমান্তভূমিগুলোর মধ্যে বিশ্বের দুটি সর্বাধিক জনবহুল দেশ ক্রমবর্ধমান একে-অপরের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ায় আরো প্রকট সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে।
সর্বশেষ লাদাখে সীমান্ত-বিবাদ নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে যে সামরিক ও কূটনৈতিক আলোচনা চলছে, সেটির ফলাফল সন্তোষজনক হবে কি না, সেটি নিয়ে বেশ সংশয় থেকে যাচ্ছে। কারণ কোনোভাবেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তাদের নিজেদের সম্মানে আঘাত লাগতে দেবে না। আবার চীনও উত্তেজক অবস্থায়। বিশেষ করে চীন ও ভারতের মধ্যে তাদের ১৩০০ কিলোমিটার সীমান্ত নিয়ে বিরোধ দীর্ঘদিনে হওয়ায় এর সমাধানও অতটা সহজ নয়।
তা ছাড়া সরলভাবে এটাও মনে করা হচ্ছে, লাদাখে ভারতের রাস্তা কিংবা অবকাঠামো উন্নয়ন চীনের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এই সংকটের ক্ষেত্রে আরো যে বিষয়টি সামনে চলে আসছে, সেটি হলো বর্তমান বিশ্বরাজনীতির মেরুকরণ। জোট বেঁধে চীনকে কোণঠাসা করার যে চেষ্টা যুক্তরাষ্ট্র শুরু করেছে, চীন ভারতকে সেই জোটের অংশ হিসেবে দেখছে; বিধায় সংকট ক্রমেই ঘনীভূত হয়েছে। তবে এটিও ঠিক, যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ধরাশায়ী করতে ভারতকে হাতিয়ার হিসেবে দেখতে চায়। এ জন্য তারা দীর্ঘদিন থেকে ওত পেতে আছে।
অবশ্য বিভিন্ন সময় আরো একটি বিষয় সামনে এসেছে, করোনাভাইরাসের বর্তমান পরিস্থিতির ওপর থেকে নজর এড়াতেই পরিকল্পিতভাবে চীন লাদাখ সীমান্তে উত্তেজনা বাড়াচ্ছে। কারণ বিশ্বের অনেক দেশই এই ভাইরাস ছড়ানোর জন্য চীনকে দায়ী করছে। বিশ্বব্যবস্থা চীনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় তাদের অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হতে শুরু করেছে। তবে শেষ কথা হলো, পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার আগেই যেকোনোভাবে চীন ও ভারতের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা নিরসন যৌক্তিক হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়