নতুন প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যম
দিন বদলেছে। আগে সাংবাদিকদের প্রতিবেদন নিয়ে সরকারকে মূল্যায়ন করত মানুষ। এখন নাকি সরকারই সাংবাদিকদের মূল্যায়ন করে। সেই মূল্যায়নে আবার খোদ সাংবাদিকদেরই ব্যাপক আগ্রহ। আমি সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। আমরা বরং বাংলাদেশে গত কয়েক বছরের পরিবর্তনের দিকে দৃষ্টি দেই।
আমরা দেখি নির্বাচন এলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে বেশ বড় বড় কথা বলে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো। আমরা সাংবাদিকরাও খুশি হই রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে আমাদের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা উঠে এলে। আমরা আরো খুশি হই দলসমূহ বিরোধী অবস্থানে থেকে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানালে।
রাজনৈতিক দল বা নেতাদের মুখ থেকে গণমাধ্যমের এমন সব প্রতিশ্রুতি আর উদ্বেগ আশা জাগায় ঠিকই, কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন। এবং এই সংকট নতুন নয়। কিন্তু করোনাকালে আমাদের প্রতি যা প্রদর্শিত হয়েছে, সাংবাদিকরা সে কথা মনে রাখবে কতদিন জানি না। এমন এক মহামারি আর মহামন্দাকালে সব শ্রেণির সরকারি কর্মী যখন শুধু করোনায় আক্রান্ত হলেই লাখ টাকার প্রণোদনা পেয়ে যায়, ব্যবসায়ীদের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার কথা বারবার উচ্চারিত হতে থাকে, চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বড় অঙ্কের বিমার ঘোষণা আসে, তখন সাংবাদিকদের কপালে কিছু জোটেনি।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, মানুষকে নিরলস তথ্যসেবা দিতে গিয়ে মারা গেছে সাংবাদিক, আক্রান্ত শতাধিক, কিন্তু রাষ্ট্র বা সামাজিক প্রতিষ্ঠান, কোনো স্তর থেকেই কোনো সহায়তার বাণী উচ্চারিত হয়নি, কেউ এগিয়ে আসেনি। তবে সাংবাদিক সংগঠনগুলো যখন নিজেদের জন্য নিজেরা কিছু করার উদ্যোগ নিয়েছে, তখন কেউ কেউ দু-এক পা করে কাছে এসেছে।
তাই এই জমানায় নাগরিকের বাকস্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে আমরা যত বড়াই করি না কেন, ধারণা করছি সেটি সমাজে ও রাষ্ট্রে ঠিকমতো অনুভূত হচ্ছে না। সাংবাদিকের প্রতি কোনো দলই সদয় নয়, সমাজও নয়। গণমাধ্যমের এমন দুর্দিন ইতিহাসে বিরল। বিরল এ কারণে, এমন দুর্দিনেও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়, তাদের জেলে যেতে হয়, কিন্তু নাগরিক সমাজ থেকে কোনো প্রতিবাদ হয় না, সাংবাদিক সংগঠনগুলোও আনুষ্ঠানিকভাবে নীরবতা পালন করে।
রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে সক্রিয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম গণমাধ্যম। তথ্যপ্রযুক্তির বিন্যাসে সমাজের পক্ষে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনই গণমাধ্যমের প্রাথমিক কাজ। দুই দশক আগেও রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ টেলিভিশন ছিল একমাত্র ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যম। তবে ব্যক্তি খাতে সংবাদমাধ্যম ছিল প্রচুর। সরকারি বিজ্ঞাপনের টাকা আর নিউজপ্রিন্ট আমদানির কোটা ব্যবহারের লোভে পত্রিকার সংখ্যা এখনো বাড়তি। ২০০০ সালের শুরুতে একুশে টেলিভিশনের মাধ্যমে সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে স্বাধীন খবর পেতে শুরু করে বাংলাদেশের মানুষ। দেশের মানুষ উল্লসিত হয়ে ওঠে সরকারি স্বরের বাইরে দেশের ও দেশের বাইরের খবর পাওয়ায়। একুশে টিভি জামায়াত-বিএনপি সরকারের রোষানলে পড়ে বন্ধ হয়েছে, আবার খুলেছে বহু বছর পর। তবে আমাদের গণমাধ্যমজগতে বিচ্ছুরণ ঘটেছে একটার পর একটা বেসরকারি নিউজ় চ্যানেলের। তথ্যভিত্তিক যুক্তির সাহায্যে বহুস্বর, অভিমত ও প্রশ্ন উদযাপনের যে আশা ছিল মানুষের মনে, তার কিছুটা পূরণ হয়েছে। আবার কোথাও হয়তো সেটার আধিক্যে জটলাও লেগেছে।
এখন টেলিভিশন মানে ব্রেকিং নিউজ আর টকশোর অবিরাম স্রোত। জনগণের চাওয়া, সমাজের নানা অসঙ্গতি আর অনিয়মের কথা তুলে ধরবে গণমাধ্যম। তবে সরকারি দল মানেই চায় গণমাধ্যম সম্ভাবনা আর প্রত্যাশার কথা ছড়াবে শুধু। তার যেন আর অন্য কোনো দায়িত্ব নেই।
মানুষের চাওয়া, সরকারের চাওয়া এই দুইয়ের মাঝে কোথায় যাবে এটা ঠিক করতে করতে সাংবাদিকরা দেখে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে মানুষের হাতে হাতে চলে আসা সামাজিক মাধ্যম। গণমাধ্যম কোথাও তথ্য দিতে ভুল করলে, ব্যর্থ হলেও মানুষের অসুবিধা হচ্ছে না, ঠিকই তার প্রাপ্তি ঘটছে নিজেদের মতো করে।
তার পরও গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা কখনো কখনো মানুষকে, রাষ্ট্রকে বুঝতে হয়। যেমন এই করোনাকালে গুজব, মিথ্যা তথ্যের প্রসারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় বিকল্প মূলধারার গণমাধ্যম। তবুও সমাজ আর রাষ্ট্র থেকে সব সময় যেন একটা অবজ্ঞাই পেয়ে আসছে গণমাধ্যম। কেন পাচ্ছে না, তার একটা মূল্যায়ন সাংবাদিকরা নিজেরাই করতে পারেন। তবে যা চায় তা দিতে না পারলে সমাজে সাংবাদিকের কদর কমে। বোঝা দরকার, সরকার বা সরকার-বিরোধীদলের সমর্থক হওয়ার মাঝে তার মুক্তি নেই। সরকার-পরিপন্থী কোনো দায়িত্ব পালন তার কাজ না, তবে সরকার যেন গণমাধ্যমের মাধ্যমেই দেখতে পায় কোথায় তার আরো কাজ করা প্রয়োজন। সে কাজটা সাহস আর ন্যায্যতার সঙ্গে করাই বড় দায়িত্ব।
প্রযুক্তির কল্যাণে নিজেদের অন্যভাবে দেখছে মানুষ। মানুষকে টানছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পর্দা। এই ডিজিটাল দুনিয়ায় মিডিয়া এজেন্ডা ঠিক করছে না, বরং মিডিয়ার এজেন্ডা ঠিক করে দিচ্ছে মানুষ। আর সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা যাদের আসল গণমাধ্যম বলি, তাদের অক্ষমতা আর দুর্বলতা মানুষের চোখে পড়ে দ্রুত। রাষ্ট্র ও সমাজের যে নয়া সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, তার নিরিখেই খবরের পর্দায় বা পাতায় পরিবর্তন আসতে বাধ্য।
যাদের কাছে তথ্য আছে, তথ্যের যারা ভোক্তা, বিজ্ঞাপন দাতাদের কাছে গণমাধ্যম নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পারলেই তার আগামী আছে। আবার যারা গণমাধ্যমকে ভুলে থাকতে চাইছেন, তাদেরও ভাবনার জগতে পরিবর্তন আনতে হবে। গণমাধ্যম কেবল সময় কাটানোর মাধ্যম নয়, তথ্যসেবা দেওয়ার বাহন, সমাজের মূল্যবোধ আর সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন সৃজনের প্রতিষ্ঠান। সংবাদের স্বাতন্ত্র্য, সাংবাদিকের মর্যাদা, এসব বিষয় রাজনীতির প্রচারে, সমাজের গভীরে গুরুত্ব পেলে গণতন্ত্র সুরক্ষা পায়।
লেখক : সাংবাদিক