বাজেটের অঙ্ক কি মিলবে?
করোনাভাইরাসের গ্রাসে অর্থনীতি। সারা বিশ্বেই আর্থিক প্রবৃদ্ধির হার ব্যাপকভাবে কমছে। কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে অর্থনীতি, এ নিয়ে চিন্তা সব মহলে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নিজেও তাঁর বাজেট-বক্তৃতার ছত্রে ছত্রে করোনার সর্বগ্রাসী আগ্রাসন নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু সবশেষে তিনি আবার সংখ্যাতেই ভরসা রেখেছেন করোনার অভিঘাতকে দূরে সরিয়ে রেখে।
কিছুদিন আগে ২০১৯ সালের অর্থনীতি কেমন ছিল, ২০২০-এ কেমন হতে পারে, তার আগাম পূর্বাভাস দিতে গিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, এ বছর উন্নত ও উন্নয়নশীল অধিকাংশ দেশেই ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হবে। অর্থনীতির আঙিনায় খারাপ হাওয়া ছিল করোনা আসার আগে থেকেই। করোনা এসে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে সবকিছু। স্বাস্থ্য খাতের করুণ দশা আজ উন্মোচিত পুরো দেশবাসীর কাছে। তবুও ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা রেখে বাজেট দিলেন মুস্তফা কামাল। বাজেট ঘোষণার দুদিন আগে বিশ্বব্যাংক বলল, আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার হবে মাত্র ১ শতাংশ। বাজেটের কোনো অঙ্কই মেলাতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় সর্বত্র; কিন্তু মন্ত্রী বলছেন এই বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য।
বাজেটোত্তর ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘এবারের বাজেট আমরা স্বাভাবিক নিয়মে করতে পারিনি। এটি গতানুগতিক বাজেট নয়।’ কিন্তু বাজেট প্রস্তাবনাগুলো পড়লে দেখা যায়, তিনি পুরোনো চেনা ছকেই হেঁটেছেন। করোনা মহামারির কথা বললেও বাজেটে এ মহামারির প্রভাব অর্থনীতিতে কী হতে পারে, তা এড়িয়ে গেছেন মন্ত্রী। করোনার গ্রাসে যে স্বাস্থ্য খাতের রুগ্ণ চেহারাটা আজ জাতি দেখছে, সেখানে সামান্য বরাদ্দ বাড়ানো হলেও এ খাতের মোট বরাদ্দ দেশের জিডিপির ১ শতাংশের নিচেই থাকল।
সরকার যখন নিজের অফিসগুলো ২৫ শতাংশের বেশি লোক দিয়ে চালাতে পারছে না, বেসরকারি খাত পুরোপুরি সক্রিয় হয়নি, কবে হবে তার কোনো বাস্তব জ্ঞান নেই, তখনো বাজেটে এ বছরের সংশোধিত রাজস্ব সংগ্রহের চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। আগামী অর্থবছরে এনবিআরকে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় করতে হবে ভ্যাটে। এই খাতে এক লাখ ২৮ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা আদায় করার লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আয়কর থেকে আসবে এক লাখ পাঁচ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা এবং শুল্ক খাত থেকে আসবে ৯৫ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা। তিন খাতের কোনো খাতই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবে না জেনেও বড় লক্ষ্যমাত্রা কেন, সেটা অর্থমন্ত্রীই ভালো বলতে পারবেন। তবে ভ্যাটের ওপর অতি নির্ভরশীলতার অর্থ হলো রাষ্ট্র পরোক্ষ কর চাপিয়ে দিচ্ছে মানুষের ওপর, যা অতিমাত্রায় নিবর্তনমূলক।
অর্থনীতির ঝিমুনির ফলে অর্থমন্ত্রী বাজেটে যে কর বাবদ আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিলেন, গত অর্থবছরে তা থেকে বহুদূর পিছিয়ে আছে এনবিআর। কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় না হলে সরকার বাধ্য হয়েই ব্যাংকের ওপর বেশি নির্ভর হয়ে পড়বে। ব্যাংকিং খাতের অবস্থা এমনিতেই ভালো না। সরকার ব্যাংকের টাকার ওপর অতিনির্ভর হলে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পাবে না। এটা জেনেও বাজেটে বলা হয়েছে, আগামী অর্থবছরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ হবে জিডিপির ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ, যদিও এ বছর তা হয়েছে ১২ দশমকি ৭ শতাংশ। গত এক দশকের বেশি সময়ে বেসরকারি বিনিয়োগে কোনো গতি নেই, এই গতি আরো স্তব্ধ হয়েছে করোনার আঘাতে। যত আশঙ্কা যেখানেই উচ্চারিত হোক না কেন, অর্থমন্ত্রী মনে করেন এ বছর বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়বে।
এনবিআর চেয়ারম্যান বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে উজ্জীবিত থাকলেও মাথায় হাত পড়েছে রাজস্ব কর্মকর্তাদের। রাজস্ব দপ্তরের কর্তাদের অনুমান, লক্ষ্যমাত্রা ছোঁয়া দূরে থাক, শেষমেশ ঘরে কত আসবে, তা নিয়েই ঘোর সংশয়ে তাঁরা।
অর্থনীতির গতি কমে গেলে আমজনতা থেকে করপোরেট সংস্থা, কারো আয়ই তেমন বাড়ে না। ব্যবসা-বাণিজ্যও কম হয়। ফলে কর বাবদ রোজগার কমে সরকারের। তবুও অর্থমন্ত্রী তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির করপোরেট কর কমিয়েছেন আড়াই শতাংশ, যাকে ব্যবসায়ী মহল স্বাগত জানিয়েছে।
অর্থমন্ত্রী অবশ্য বারবারই দেশের অর্থনীতির সামনে যত ধরনের ঝুঁকি ও আশঙ্কা আছে, সব বলেছেন। ছাড় দিয়েছেন স্থানীয় শিল্পকে। বহুদিন পর ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়িয়ে বছরে তিন লাখ টাকা করা হয়েছে। বর্তমানে এটি আড়াই লাখ টাকা। সহজ পথে হেঁটে তিনি গাড়ি, সিগারেট আর মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর উচ্চ হারে শুল্ক বসিয়েছেন।
অর্থমন্ত্রী অপ্রয়োজনীয় সরকারি ব্যয় পরিহারের নির্দেশনা রেখেছেন বাজেটে। কিন্তু আমাদের আমলাতন্ত্র সেটা কতটা করতে দেবে, সে এক বড় প্রশ্ন। করোনায় বিপর্যস্ত অবস্থাতেও জনপ্রশাসন খাতে উচ্চ বরাদ্দ (১৯.৯%) এর এক দৃষ্টান্ত। এই আমলাতন্ত্র সরকারের কাছ থেকে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি পদায়ন ও পদোন্নতি বারবার আদায় করছে এবং করোনাকালেও এ ধরনের পদন্নোতির নজির দেখেছি আমরা। করোনাকালে সরকারি কর্মকর্তারা অফিস না করলেও বেসরকারি খাত এবং সাধারণ মানুষ যেখানে বাড়ি থেকে অফিস ও ব্যবসা-বাণিজ্য চালাচ্ছে, অর্থনীতিকে কিছুটা হলেও সচল রেখেছে, সেখানে ইন্টারনেট, মোবাইল রিচার্জ, অনলাইন কেনাকাটার ওপর ঢালাও হারে কর আরোপ করা হয়েছে। স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। কালো টাকা ঢালাওভাবে সাদা করার প্রস্তাবনা রেখে আরো একবার সৎমানুষকে বিদ্রুপ করা হয়েছে।
কর ফাঁকি, কর জালিয়াতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা প্রয়োজন, প্রয়োজন ব্যাংকিং খাতে সুশাসন। আর সরকারি অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে বাস্তবসম্মত হওয়া, উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যাপারে আরো মিতব্যয়ী হওয়া, তবেই হয়তো কিছুটা রক্ষা হতে পারে। বাজেটের দিন মানে আর্থিক ভাবনা উন্মোচনের দিন। করোনায় যারা চাকরি হারাল, রোজগার হারাল, বিদেশ থেকে ফেরত এলো, সেই ভাবনা কতটা সরকারের আছে তা বুঝতে সময় লাগবে আরো কিছুদিন। বাজেটের বিশ্বাসযোগ্যতার ভিত্তি হলো প্রতিশ্রুতি, বরাদ্দ এবং খরচের মধ্যে সাযুজ্য। সেটা কি থাকবে?
লেখক : সাংবাদিক