বাবা আমার বাবা
মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছি। বাবা (খন্দকার রফিকুল ইসলাম) আমার কাছে এখনও স্বপ্নের মতো। দুর্দান্ত আধুনিক, স্টাইলিস্ট, রুচিশীল, শৌখিন, জ্ঞানী, মানবিক ও সংস্কৃতিমান ছিলেন। যখন কবিতা আবৃত্তি করতেন ‘বলো বীর বলো চির উন্নত মম শির’, কিছু বুঝতাম না; কিন্তু কেঁপে উঠতাম তাঁর কবিতা শুনে। তাঁর হাতের লোমকূপ দেখতাম শিহরিত হয়ে ফুলে উঠছে আবেগে!
একবার জসীমউদ্দীনের ‘কবর’ নাটক তিনি তাঁর অফিসার্স প্রোগ্রামে মঞ্চস্থ করলেন। যখন বুড়ো সেজে এক বাচ্চাকে হাত ধরে বলে উঠলেন, ‘ঐ খানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে’; মনে আছে, হলের সবাই হু হু করে কেঁদে ফেলেছিলেন। গান এত পছন্দ করতেন যে গানের ক্যাসেটে ভর্তি ছিল শোকেস। হুইলে মাছ মারা তাঁর শখ ছিল। মনে আছে, একবার এত বড় মাছ ধরে এনেছিলেন যে তার একটা আসলেই এত বড় ছিল, অবাক হয়েছিলাম। সারা অফিসার্স কোয়ার্টারে আম্মু এই মাছ বিলি করেছিলেন। আমাদের শেখাতেন মাছ মারা, কবিতা, ওস্তাদ রেখে গান। এসব তখন টর্চার মনে হতো। স্কুল প্রোগ্রামে তখন ফার্স্ট প্রাইজ পাওয়া ছিল ওয়ান টু! সাথে নিয়ে ক্যারাম খেলতেন, মেতে উঠতেন বাচ্চাদের মতো। টিভি দেখতেন সাথে নিয়ে—সব ভালো অনুষ্ঠানগুলো। আবার শবেবরাতের রাতে সাথে নিয়ে নামাজ পড়তেন।
ঘুম আসলে বলতেন—যাও, ঘাড়ে পানি দিলে ঘুম চলে যাবে। কেনাকাটায় ছিলেন শৌখিন। বাজারের শ্রেষ্ঠ জিনিস তাঁর চাই-ই চাই। কলাম লিখতেন পত্রিকায়। কত বই যে পড়তেন। প্রতি সপ্তাহান্তে বাইরে বের হতেন সাথে নিয়ে, উদ্দেশ্য শপিং শেষে বাইরে লাঞ্চ বা ডিনার, দামি আইসক্রিম পার্লারে আইসক্রিম, হলে গিয়ে সিনেমা দেখা। কলেজজীবনে রাজনীতি করতেন, ভিপি ছিলেন। কোনোদিন বলেননি তিনি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। জানতে পেরেছি পাঁচ-ছয় বছর আগে। মাননীয় তোফায়েল আহমেদের সাইন করা মুক্তিযুদ্ধ সার্টিফিকেট ও প্রত্যয়নপত্র আবিষ্কার করেছি এই সেদিন।
বাবা হয়তো সবার আছে। সব বাবাই তাঁর সন্তানকে ভালোবাসেন। কিন্তু আমার বাবার মতো সন্তানের প্রতিটি মুহূর্তে মিশে থাকা বাবা আমি দেখিনি! তিনি সন্তানের প্রতিটি দিন রঙিন করে দারুণ ভাবে উদযাপন করতেন। প্রতিটি ক্ষণ ও মুহূর্তে মিশে থাকতেন। হয়তো ক্ষণজন্মা ছিলেন বলেই প্রতিটি মুহূর্ত সন্তানদের সাথে উদযাপন করে গেছেন! তিনি মারা গেছেন আমাদের এখন যা বয়স—এই বয়সে! আমি বড় সন্তান ছিলাম। আমার মায়ের সংসারজীবন মাত্র ১৩ বছর। গতকাল ছিল বিশ্ব বাবা দিবস। বাবা দিবসে আমার স্বপ্নের বাবাকে আমি তাই স্বপ্নেই রাখি, স্বপ্নেই দেখি! বাবা আমার বাবা, কত দিন কত কাল দেখিনি তোমায়…
তাই বাবা মানেই আজ স্বপ্ন। বাবা মানেই ছিল সপ্তাহান্তে ঘোরাঘুরি, শিশুপার্ক, চাইনিজ। বাবা মানেই ছিল কবিতা, গান, অভিনয়ে প্রথম পুরস্কার। বাবা মানেই ছিল অ্যাকুরিয়াম-ভর্তি লাল-নীল মাছ। বাবা মানেই ছিল বাজারের সবচেয়ে ফ্যাশনেবল জামা। বাবা মানেই ছিল বাজারের সবচেয়ে বড় মাছ, ভাত খেতে দু-চারটা ইলিশ মাছের পেটি। বাবা মানেই ছিল সুখভর্তি বিলাসী জীবন যাপন। বাবা নেই সেই ১৯৮৭ সাল থেকে; হয়তো বাবা আসেন আমার স্বপ্নে এসব জীবন ফেরত দিতে। যেন ভুলে কোথাও ভুল করে চলে গেছেন, উনি ফিরে এসে বলেন, আমি মরিনি তো; অতঃপর আমাদের মিলনের কান্নাকাটি শেষে অনেক দিন তাঁর সাথে ঘোরা হয়নি বলে নিয়ে যান সদলবলে সিনেমাতে, দামি আইসক্রিম পার্লারটিতে, চাইনিজে। তিনি আমার কাছে বার বার জীবিত হয়ে ফিরে আসেন; কারণ, তাঁর মরা মুখটি শেষ অবধি দেখার সুযোগ ও দুর্ভাগ্য আমার হয়নি বলে! তাঁকে হেঁটে হেঁটে যে এগিয়ে দিয়েছিলাম, এই তাঁর সাথে আমার শেষ স্মৃতি। হেঁটে হেঁটে এগিয়ে দেওয়া সব বিলাসী সুখের সমাপ্তি।
আমার নানা জেলার ছিলেন। তাঁর মতো ভালো মানুষ পৃথিবীতে কোনোদিন জন্মেনি এবং কোনোদিন জন্মাবে না; কেননা ফেরেশতারা জন্ম নেয় না, ভুল করে পথ ভুলে টুপ করে পড়ে যায়! আমার দাদা কৃষি অফিসার ছিলেন। তাঁর সঙ্গ তেমন পাইনি। তোমরা ভালো থেকো, যেখানেই থাকো, সব বাবারা। আমি একটা বাবা পেয়েছি, আমার শ্বশুর আইনজীবী; তাঁর জন্য দোয়া করো তোমরা। বাবা, তোমার স্বল্প জীবনকাল নিয়ে তাঁর দীর্ঘ জীবন যেন ব্যালান্স হয়! আমিন।