বিএনপি : এক অমীমাংসিত কৌতূহল
গত বছর ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যা হওয়ার, তাই হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট আটটি বাদে সব আসনে বিজয়ী হয়ে এখন আরো প্রতাপশালী হয়ে সরকার পরিচালনা করছে। এই নির্বাচন নিয়ে নানা কথা বলে সামাজিক মাধ্যম আর টেলিভিশন টকশোতে ঝড় তুললেও বিএনপি বা তার জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বা তাদের বুদ্ধিজীবীরা মানুষের মধ্যে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। সংসদে যাব না যাব না করে গিয়েছেও শেষ পর্যন্ত।
২০১৪-এ কৌশলগত ভুলের কারণে নির্বাচন বর্জন করে দলটি বড় ধাক্কা খেয়েছিল। ২০১৮-তে এসে জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট নামে এক প্লাটফর্ম থেকে অন্যের ঘাড়ে ভর করে ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সেটাও সফল হয়নি। বেগম খালেদা জিয়া জেলে থাকায় দলের গুলশান অফিস স্তব্ধ, পল্টন অফিসের একমাত্র আলো রুহুল কবীর রিজভী, একমাত্র সক্রিয়তা আছে তারেক রহমানের লন্ডন পয়েন্টের। গুরুত্বপূর্ণ নেতারা কর্মসূছি ছাড়া দলের কার্যালয়ে খুব একটা যান না। অনেকে একেবারেই দলের কোনো কাজে ভিড়েন না। ঠিক এমন এক বাস্তবতায় মনে হচ্ছে দলের অন্দরে একটা ভাবনা এসে ঘুরপাক খাচ্ছে যে কে ‘বড় প্রতিপক্ষ’ - সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগ না নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ?
এমনটি ভাবার কারণ হলো, সম্প্রতি দলের দুজন সিনিয়র নেতার পদত্যাগ। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান এবং ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খানের পদত্যাগের বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচিত হচ্ছে। মাহবুবুর রহমান শারীরিক অসুস্থতার কথা বললেও, দলের চেয়ারম্যান খালেদা জিয়া কারাবন্দি থাকায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বপ্রাপ্ত তারেক রহমানের নেতৃত্বের নানা সমালোচনা করেছেন মোর্শেদ খান। পদত্যাগের পরের দিন মোর্শেদ খান গণমাধ্যমে বিএনপির পরিচালনা পদ্ধতি ও নেতৃত্ব নিয়ে সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, বিএনপি এত বড় একটা দল, এক বিশাল জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা জনমানুষের কাছে। প্রবীণ এ রাজনীতিক বলেন, আমি মনে করছি, এ দলে এখন আমার কনট্রিবিউশন করার মতো কিছু নেই। নতুন প্রজন্মকে এ দলের নেতৃত্বে নিয়ে আসতে হবে, এটাই আমার পরামর্শ।
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৈরী পরিস্থিতিতেও নির্বাচনে জিতেছিলেন, কিন্তু তাঁকে সংসদে না পাঠিয়ে দলের লন্ডন নেতৃত্ব পাঠিয়েছেন অন্যদের। সেই হাওয়া ভবন আর না থাকলেও হাওয়ায় রসিকতা ভাসে, বিএনপি নেতৃত্ব নাকি এখন শুধু লন্ডনের প্রদর্শিত পথে হাঁটছে। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত যেমনই আসুক, ভালোমন্দ বলার উপায় নেই।
গত কয়েক বছরে বিএনপি যেন রাজনীতির কেন্দ্রস্থল হতেই সরে গেছে। জেনারেল জিয়ার মৃত্যুর পর থেকে দলের সবকিছু আবর্তিত হয়ে আসছিল বেগম খালেদা জিয়াকে কেন্দ্র করে। দলের সব স্তরের নেতা-কর্মীরাও মনে করে বেগম খালেদা জিয়াই তাদের সব। অথচ তাঁর মুক্তির ব্যাপারে মানুষকে জাগাতেই পারেনি দলটি। অবস্থা এমন যে, এখন মাঝেমধ্যে বেগম জিয়া খবরের শিরোনাম হন কেবল তার সঙ্গে স্বজনরা দেখা করে অসুস্থতার কথা জানালে।
মানুষ একটি দলকে শুধু ভোটের জন্য বেছে নেয় না। মানুষের দৃষ্টি থাকে দলের নীতি ও সমাজে তার অবস্থানের ওপর। দলের কর্মীরা যে প্রাসঙ্গিক রাজনীতি চায় সেটি দলের নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে দল থেকেই মাঝেমধ্যে আওয়াজ উঠে।
একযুগ ধরে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে রয়েছে। এই পুরো সময়টায় দলটিকে বিপর্যয়ের মধ্যে থেকে চলতে হয়েছে। সর্বশেষ খালেদা জিয়ার জেলে যাওয়ার বিষয়টি দলটিকে বড় সংকটে ফেলেছে। এমন বাস্তবতায় দলের নেতৃত্ব লন্ডনে তারেক রহমানের কাছে স্থানাস্তরিত হলেও এর কোন ইতিবাচক প্রভাব আসেনি নেতাকর্মীদের মধ্যে। মোর্শেদ খান আর মাহবুবুর রহমান সরে গেছেন। এর আগে দল ছেড়েছেন শমসের মবিন চৌধুরী। শীর্ষ নেতৃত্ব যতই লাগাম টানার চেষ্টা করুন, দলের হালচালে বিরক্ত বিএনপি নেতাদের মুখ খোলার প্রবণতা রোখা যাচ্ছে না, এটাই বাস্তবতা। এই তিন নেতার পদত্যাগ দল সম্পর্কে এই ধারণা দেয় যে, মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে দলের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ খারাপ হতে বাধ্য।
দলের উপরের তলার বাসিন্দা মোর্শেদ খান, শমসের মোবিন চৌধুরী ও জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান। মোর্শেদ খান তার ক্ষোভটা লুকিয়ে রাখেননি, তবে অসন্তোষটা নানা স্তরেই ছড়িয়েছে। দল কেন সাধারণ মানুষের উপকার হয় এমন ইস্যুতে দাঁড়াতে পারে না, সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় দলের নিচতলার নেতাকর্মীদেরই। মোর্শেদ খানের ভাষায় দলের সমর্থক অনেক। কিন্তু কর্মীদের উপযোগী কর্মসূচির মধ্যে জাগ্রত করতে না পারলে একটা দলকে কেউ টেনে নিয়ে যেতে পারে না।
মোর্শেদ খানদের পদত্যাগ দলের আরো কাউকে দল ছাড়তে উৎসাহিত করবে কি না, সেই আশংকা আছে দলের ভেতরে। বিএনপির নেতৃত্বের সংকট, কী ধরনের কৌশল হবে রাজনীতিতে, তার কোনো দিক নির্দেশনা নেই অনেকদিন ধরেই। নির্বাচন অভিযোগ যতই থাকুক, বাস্তবতা হলো তাদের পরাজয়। নির্বাচনে ভরাডুবির পর মানুষের কাছে কোনো জোরালো আহ্বান চোখে পড়েনি। অনেকদিন ধরেই এই কৌতূহলটা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলে। সেই কৌতূহলটা অমীমাংসিত থাকছে বারবার।
লেখক : এডিটর ইন চিফ, সারাবাংলা ও জিটিভি।