বিধি মানলে সুস্থ থাকা যায়, রাখা যায়
চার মাস হয়ে গেল। অনেক দেশ এই সময়ে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এনে জীবন-জীবিকা স্বাভাবিক করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে আবার জাগিয়ে তোলার লড়াই শুরু করেছে। বাংলাদেশ কোন পথে হাঁটছে, সে এক বড় প্রশ্ন। সরকার চেষ্টা করেছে মানুষ যেন জীবিকা না হারিয়ে ফেলে, আর সে জন্য পোশাকশিল্পের জন্য প্রণোদনা, হতদরিদ্রদের খাদ্য ও নগদ সাহায্য করা, ব্যবসা-বাণিজ্য খুলে দিয়ে মানুষের আয়ের পথে উন্মুক্ত করার কাজটি করেছে। তবে সরকারি অফিস খুললেও উপস্থিতি খুবই কম।
করোনা পরীক্ষা কমছে, ফলে প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। তারপরও মৃত্যুহার কম হওয়ায় একপ্রকার স্বস্তি আছে সর্বত্র। সামনে কোরবানির ঈদ। ফলে পশুর হাট হবে, মানুষ বাড়ি আসা-যাওয়া করবে এবং সেটা আবার সংক্রমণ বিস্তারের পথ সৃষ্টি করবে। রোগী শনাক্তকরণ, আইসোলেশন, বেশি বেশি পরীক্ষা—এ কাজগুলো এখনো দুর্বলই থেকে গেল। তবে ঢাকাসহ জেলায় জেলায় এলাকাভিত্তিক লকডাউন চলছে এবং সেগুলোর ফলাফল নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে।
নভেল করোনাভাইরাস ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে, নাকি আমাদের নাগরিকদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, এমন প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া কঠিন। তবে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)-এর একদল গবেষক বলেছেন, এ দেশে করোনাভাইরাস ইতোমধ্যে তা জিনোমিক পর্যায়ে ৫৯০টি ও প্রোটিন পর্যায়ে ২৭৩টি পরিবর্তন ঘটিয়েছে। একটি করোনাভাইরাসে এক হাজার ২৭৪টি প্রোটিন থাকে এবং এর মধ্যে ‘ডি৬১৪জি’ প্রোটিনটি বাংলাদেশে সক্রিয়, যেটি আবার মহামারি ঘটাবার মতো বিপজ্জনক নয়। এটি সুখবরই বটে। তাই বলে অতি উচ্ছ্বসিত হওয়ার কারণ নেই। প্রতিদিনই আড়াইটার বুলেটিনে মৃত্যুর কথা বলতে হচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে। তবে এখনই ভাইরাসের ক্ষমতা কমে গেছে বললে সাধারণ মানুষ সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি শিকেয় তুলে দিলে সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাবে।
ঠিক এ অবস্থায় নাগরিক সচেতনতার বিষয়টি আলোচনায় আসবেই। লকডাউন, করোনার নমুনা পরীক্ষা, আইসোলেশন কোনো কিছুই ঠিকমতো হয়নি। সরকার ব্যর্থ, এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া যাবে ঠিকই, কিন্তু বাঁচতে হলে নিজের কাজটাও করতে হবে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে যেসব সাধারণ সুরক্ষাবিধি আছে, সেগুলো মানার ব্যাপারে আমাদের এখানে অনীহা লক্ষণীয়। বাইরে মাস্ক পরছি না আমরা। প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাওয়ার নিষেধও শুনছি কম। গেলে বাজারে, দোকানে, রাস্তায়, ফুটপাতে, পাড়ার চা স্টলে কোথাও শারীরিক দূরত্বের বিধান মানছি না। সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার বিষয়টি মনিটর করা কঠিন।
টেলিভিশনে নিয়মিত মাস্কের কথা বলা হচ্ছে। রিপোর্টাররা জিজ্ঞেস করলেই মানুষ এই তো আছে বলে পকেট থেকে বের করছেন, কেউ বলছেন বাড়িতে রেখে এসেছেন আর জনতার একটি বড় অংশ মাস্ক থুতনিতে নিয়ে ঘুরছেন। করোনায় বাংলাদেশে যারা মারা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে তরুণদের হার বেশি। এর একটা অন্যতম কারণ এরা শুরু থেকে নিষেধ মানছিল না। সাধারণ ছুটি বা লকডাউন যা-ই থাকুক, এরা বাইরে বের হয়েছে, আড্ডা দিয়েছে, ঘোরাঘুরি করেছে এবং এখনো করছে। পূর্ব রাজাবাজার ও ওয়ারীর লকডাউন অভিজ্ঞতায় দেখেছি, মানুষজন নানা উছিলায় ঘর থেকে বের হচ্ছে। বারবার সতর্ক করা হয়েছে, রাস্তায় দোকানে বাজারে ভিড় করবেন না, প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাবেন না, এমনকি বাজারেও। কিন্তু কে শুনছে কার কথা! এমনই ভয়ংকর কারো কারো আচরণ যে ওয়ারী থেকে তিনটি করোনা শনাক্ত পরিবার সবাইকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেছে।
শারীরিক ও সামাজিক দূরত্বের বিধি না মানার জন্য কিছু লোক বেপরোয়া। বাজার তো বটেই, সর্বত্র ‘কিছু হবে না’ ভাব আছে একটা। পাড়ায় পাড়ায় অলিগলিতে জম্পেশ আড্ডা, চায়ের দোকানে গা-ঘেঁষে সিগারেট আর চা পান চলছেই। প্রথম দিকের তুলনায় এখন অনেকেই সচেতন হচ্ছেন, কিন্তু তারাও এই বেপরোয়াদের জন্য সংক্রমণের ঝুঁকিতে আছেন।
এ কথা ঠিক যে করোনা সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ফলে অল্প উপসর্গ দেখা দিলেই মানুষ চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছে। অনেকে নিজেরাই চিকিৎসা পদ্ধতি জেনে ঘরে নিজেকে আলাদা করছে। তবে প্রত্যেক চিকিৎসকই বলছেন, ভাইরাসের ক্ষমতা কমেছে বলে মাস্ক না পরে যত্রতত্র যাওয়া বা ভিড় বাড়ানো একেবারেই অনুচিত। সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার ও নিয়ম মেনে মাস্ক পরার মতো সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে নভেল করোনাভাইরাস ছাড়াও অন্যান্য সংক্রমণও প্রতিরোধ করা সহজ হবে। সুতরাং ভাইরাসকে উপেক্ষা না করে লড়াই বজায় রাখার পরামর্শই দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
একেবারে নতুন কোভিড-১৯ রোগ। এটি ভয়ংকর সংক্রামক। এখনো পরিষ্কার নয় এর সংক্রমণের ক্ষমতা ঠিক কতটা। ঠিক কতটা সতর্ক হলে সংক্রমণের বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করা যাবে। বিশেষজ্ঞদের উপলব্ধি, মত এবং স্বভাবতই নির্দেশও কিছুদিন অন্তর পাল্টে যাচ্ছে। তাই আলাদাভাবে সুরক্ষিত থাকা প্রত্যেক মানুষের কর্তব্য। ব্যক্তি সুরক্ষিত সুস্থ থাকলে পরিবার, অফিস, প্রতিবেশী, জনপদে সবাই ভালো থাকবে। সবাই বিধি মেনে চললে সুস্থ থাকা যায়, পরিবার, স্বজন ও প্রতিবেশীদের সুস্থ রাখা যায়।
লেখক : সাংবাদিক