যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ
মানুষের বেঁচে থাকা মানেই কিন্তু শ্বাস নেওয়া। মৃত্যু প্রসঙ্গে আমরা লিখি, ‘শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন।’ শ্বাস নেওয়াটাই আসলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি আমি আরো ভালো করে বুঝি। কারণ, ছেলেবেলা থেকেই আমি অ্যাজমার রোগী। সারা বছরই আমাকে শ্বাসকষ্টে ভুগতে হয়। নানা রকম ওষুধ আর ইনহেলার নিয়ে কোনো রকমে টিকে থাকি। যত ব্যবস্থাই নিই না কেন, শীতকালটা বড্ড কষ্টে কাটে। বয়স যত বাড়ছে, কষ্টও তত বাড়ছে।
একসময় শীত আমার প্রিয় ঋতু ছিল। কুয়াশায় রহস্যময় ভোর, শীতের টাটকা সবজি, খেজুরের রস, তাজা মাছ, শীতের পিঠা, শীতের পোশাক পরে ঘুরে বেড়ানো, রাতে লেপের ওমে ঘুম—সব মিলিয়ে শীতকালের জন্য আমি অপেক্ষা করতাম সারা বছর। কিন্তু এখন শীতের আতঙ্কে থাকি। নভেম্বর থেকে মার্চ—এ কয়টা মাস বড়ই কষ্টে কাটে। অফিসের কল্যাণে গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ পাই বলে রক্ষা। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চলাফেরা করতে হলে এই দূষিত ঢাকায় আমার বেঁচে থাকাটাই অসম্ভব হয়ে যেত। কিন্তু তারপরও এই ঢাকা শহরের ধুলা আর ধোঁয়ার রাজ্যে লাখ লাখ মানুষ বাধ্য হয়ে বেঁচে থাকছেন। তবে তাঁরা অনেক কষ্টে আছেন।
বিশ্বের বায়ুদূষণে এক নম্বর শহর ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। ঐতিহাসিক এই শহরটির বায়ুদূষণ প্রায়ই সব সীমা ছাড়িয়ে যায়। এমনকি স্কুল-কলেজ ছুটি দেওয়ার ঘটনাও ঘটে।
কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ-ভারতের ক্রিকেট ম্যাচের আগে ক্রিকেটাররা মুখে মাস্ক পরে অনুশীলন করেছিলেন। তবে ইদানীং মাঝেমধ্যেই দিল্লিকে হারিয়ে শীর্ষস্থান দখল করে নেয় ঢাকা। এই অর্জন গৌরবের নয়, গ্লানির। বায়ুদূষণের সরাসরি প্রভাব ফুসফুসে। কিন্তু শুধু ফুসফুস নয়, বায়ুদূষণের কারণে লিভার, হার্ট, কিডনিও আক্রান্ত হতে পারে। পরিসংখ্যান আর চিকিৎসকদের পরামর্শ শুনলে আতঙ্কেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। বায়ুদূষণ যেমন বাড়ছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোগীর সংখ্যাও।
ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা দুই থেকে তিন গুণ বেড়েছে। বায়ুদূষণে বেশি ঝুঁকির শিকার গর্ভবতী মা ও শিশুরা। এমনকি গর্ভবতী নারী বায়ুদূষণে আক্রান্ত হলে তার শিশু অটিজমে আক্রান্ত হতে পারে। তার মানে শিশুদের ভবিষ্যৎ তো আমরা নষ্ট করছিই, এমনকি জন্মের আগেই একটি শিশু আমাদের অবিমৃষ্যকারিতার শিকার হতে পারে। এই শিশুরা কোনোদিনই আমাদের ক্ষমা করবে না।
কিছু কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগ আছে, যেখানে আমরা অসহায়, কিছুই করার থাকে না। যেমন ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, অতিরিক্ত শীত, গরম অথবা বৃষ্টি। এই দুর্যোগগুলোও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণেই বাড়ছে। তবে বায়ুদূষণ সরাসরি আমাদের সৃষ্ট। আমরা চাইলেই এই বিপর্যয় রোধ করতে পারি, কিন্তু করছি না। মানুষের মতো এমন আত্মহননপ্রবণ প্রজাতি আর নেই। বলা হয়, বোকারা যে ডালেই বসে, সে ডাল কেটে ফেলে। কিন্তু আমরা জেনেশুনেই নিজেদের শ্বাসরোধ করছি। আমরা কি বোকা, নাকি অতি চালাক, নাকি সর্বগ্রাসী লোভ আমাদের বিবেচনাবোধও কেড়ে নিয়েছে?
গবেষণা বলছে, ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য ৫০ ভাগ দায়ী ইটভাটা। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও গৃহস্থালি বর্জ্যের দায় ৩০ ভাগ, গাড়ির ধোঁয়ায় দূষিত হয় ১০ ভাগ, শিল্প-কারখানার বর্জ্যে হয় বাকি ১০ ভাগ।
ঢাকার চারপাশে শত শত মান্ধাতা আমলের প্রযুক্তির ইটের ভাটা। বিশাল চিমনি থেকে টনকে টন ধোঁয়া ছাড়ে এসব ইটভাটা। ঢাকার চারপাশের ইটভাটা বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা আছে। কিন্তু তা কেয়ার করা হয় বলে মনে হয় না। ঢাকা থেকে বেরোতে গেলেই আপনার চোখে পড়বে সারি সারি ইটভাটা। এই ইটভাটা পরিবেশের বহুমুখী ক্ষতি করে। ধোঁয়া ছেড়ে সরাসরি বাতাসকে ক্ষতি করার বিষয় তো আছেই, ইটভাটায় জ্বালানি সরবরাহের জন্য উজাড় হয় গাছ। আর ইট পোড়াতে যে মাটির জোগাড় হয়, তাতে শেষ হয়ে যায় মাটির উর্বরতা শক্তি। অল্প টাকার লোভে কৃষক বিক্রি করে দেয় তাঁর টপ সয়েল। নির্মাণকাজের জন্য এখন অনেক বিকল্প বেরিয়েছে। ইটেরও অনেক বিকল্প আছে। তা ছাড়া ইট বানাতেও প্রচলিত ভাটার বিকল্প পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে অনেক আগেই। চাইলেই প্রায় ধোঁয়া ছাড়াই ইট পোড়ানো সম্ভব। তাই সরকার চাইলে এ মুহূর্তে পুরোনো প্রযুক্তির ইটভাটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দিতে পারে। এতে নির্মাণ খরচও বাড়বে না। আর এটি করতে পারলে ঢাকার বায়ু পরিস্থিতি ৫০ ভাগ ভালো হয়ে যাবে। এটি খুবই সহজ। শুধু দু-তিন মাস সময় দিয়ে ইটভাটা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলেই হলো। এ সিদ্ধান্ত শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশেই বাস্তবায়ন সম্ভব।
ঢাকার বায়ুদূষণের আরেকটি প্রধান কারণ গাড়ির কালো ধোঁয়া। এটিও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তিন চাকার টু স্ট্রোক ইঞ্জিনের গাড়ি নিষিদ্ধ করে ফোর স্ট্রোক ইঞ্জিন চালুর পর নাটকীয়ভাবে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছিল। এখন আলাদা কিছু করতে হবে না। শুধু বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করলেই গাড়ির কালো ধোঁয়া অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। যেসব গাড়ি কালো ধোঁয়া ছাড়ে, সেগুলো তো ফিটনেস পাওয়ার কথা না। বিআরটিএ গাড়ির ফিটনেস দেওয়ার ব্যাপারে কঠোর এবং সৎ হলেই কালো ধোঁয়ার দূষণ প্রায় শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব।
দূষণের আরেকটি বড় কারণ রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও উন্নয়ন। মেট্রোরেল প্রকল্প তো প্রতিদিন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, বায়ুদূষণ কত প্রকার ও কী কী। আমি বলছি না, বায়ুদূষণ ঠেকাতে উন্নয়নকাজ বন্ধ করে দিতে হবে। মাখা কেটে ফেলা কখনোই মাথাব্যথার সমাধান নয়। তবে সঠিক নিয়ম মেনে চললে বাতাস ঠিক রেখেই উন্নয়ন সম্ভব। মেট্রোরেলের জন্য হাজার কোটি টাকা খরচ করা গেলে বায়ুদূষণ কমাতে কোটি টাকা খরচ করা যাবে না কেন? হাইকোর্ট নিয়মিত পানি ছিটানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এই নির্দেশ ঠিকমতো মানলেই দূষণ অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু এই নির্দেশ যে মানা হয় না, আমি তার সবচেয়ে বড় সাক্ষী। কারওয়ান বাজার অফিসে বসে প্রতিদিন মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ দেখছি। কোনোদিন পানি ছিটাতে দেখিনি। শুনেছি, নামকাওয়াস্তে যে পানি ছিটানো হয়, তাও রাস্তায় ঢেলে দেওয়া হয়। অথচ পানি স্প্রে করতে হবে, যাতে বাতাসের ধুলাবালিও দূর হয়ে যায়। পানি ছিটানোর আরেকটি অতি জরুরি লক্ষ্য হওয়া উচিত, রাস্তার পাশের গাছ। শীতকালে ধুলায় গাছের পাতা ঢেকে যায়। তাতে দুটি ক্ষতি—ধুলায় গাছেরও দমবন্ধ হয়ে আসে। ফলে তারা বাতাস থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড টানতেও পারে না, অক্সিজেন ছাড়তেও পারে না। ফলে বাতাস আরো বেশি দূষিত হয়। গাছের পাতা পরিষ্কার রাখতে পারলে দূষণ কিছুটা হলেও কমবে। মেট্রোরেলের জন্য বেশ কিছু গাছ কাটতে হয়েছে। কিন্তু একটা গাছ কাটলে দুটি গাছ লাগানোর নিয়ম মানলে কিছুটা হলেও ক্ষতিপূরণ হতো। আমরা উন্নয়নের নামে পরিবেশ ধ্বংস করে দেব, কোনো নিয়ম মানব না, তাহলে আর পরিবেশের দোষ দিয়ে লাভ কী। এ ছাড়া রাস্তা খোঁড়ার কাজটা দক্ষতার সঙ্গে দ্রুতগতিতে করতে হবে। কিন্তু আমরা একবার রাস্তা খুঁড়লে তা মেরামত করার বিষয়টি ভুলেই যাই। আমাদের বাড়িঘরের নির্মাণসামগ্রী ফুটপাতে খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখি। একটু ঢেকে রাখলেই বাতাস দূষিত হবে না। গৃহস্থালি বর্জ্য এবং শিল্পবর্জ্যও ঠিক নিয়ম মেনে অপসারণ করা গেলে দূষণ কমিয়ে আনা সম্ভব।
তার মানে আমরা চাইলেই ঢাকার বায়ুর মান উন্নত করতে পারি। পুরো ব্যাপারটিই আমাদের হাতে। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা ভালো বাতাসে ফুসফুস ভরে নিশ্বাস নেব, নাকি সবার শ্বাসরোধ করে তিলে তিলে মারব। আমার ধারণা, আমাদের হাতে হলেও এটি কখনোই হবে না। কারণ, যাদের সিদ্ধান্তে ঢাকার বাতাস ভালো হতে পারবে, তাদের এসব নিয়ে ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। কারণ তাদের অফিস, বাসা, গাড়ি পুরোটাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। তাঁদের কখনোই ঢাকার দূষিত বাতাসে শ্বাস নিতে হয় না। হলে নিশ্চয়ই তাঁরা ভাবতেন। তবুও তাঁদের সুমতির দিকে আশা নিয়ে বসে থাকতে হবে অসহায় আমাদের। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণই আঁশ। যদি শ্বাসকষ্টে মরে যাই, তাহলেও অভিশাপ দিয়ে যাব—যাঁরা ইটের ভাটা করে, রাস্তা খুঁড়ে, মেট্রোরেল বানিয়ে, কালো ধোঁয়া ছেড়ে আমাদের বেঁচে থাকাটাই কষ্টকর করেছিল; যাঁদের কারণে বেঁচে থাকার মতো আমাদের মৃত্যুটাও যন্ত্রণাদায়ক হয়েছে; তাঁরাও যেন এই দুর্ভোগের শিকার হন। তাহলেই তাঁরা বুঝবেন, বুক ভরে শ্বাস নেওয়াটা কত আনন্দের, ঢাকার বাতাস ভালো করাটা কত গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক