রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কোথায়?
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আসার তিন বছর পূর্ণ হলো গতকাল ২৫ আগস্ট। প্রতিবেশী মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের মুখে প্রাণ বাঁচাতে আট লক্ষাধিক রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল। আগে থেকে আরো অসংখ্য রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ছিল এবং তিন বছর আগের সেই ১১ লাখ বাস্তুহারা রোহিঙ্গা কক্সবাজার জেলার টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলায় প্রতিষ্ঠিত শরণার্থী শিবিরগুলোতে এবং তার আশপাশে গাদাগাদি করে অবস্থান করছে। উচ্চ জন্মহারের কারণে এ সংখ্যা ১২ লাখ পেরিয়েছে।
করোনাকালে রোহিঙ্গা সমস্যার তিন বছর নিয়ে বড় কোনো আলোচনা হয়নি। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি, কোনো সক্রিয় উদ্যোগও এখন চোখে পড়ছে না। আমরা হয়তো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না, আসলে আমাদের করণীয় কী—এই না পাঠাতে পারা নিয়ে শোক করব, না আশ্রয় দেওয়ার গর্বে গর্বিত হব! রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান নিরাপত্তা এবং নাগরিক অধিকারসহ তাদের নিজ বাসভূমে ফিরে যেতে দেওয়া। কিন্তু সেটির আসলেই কোনো সুযোগ আছে কি না, কিংবা সুযোগ আর কোনোদিন হবে কিনা, সেটাও স্পষ্ট নয়।
বাস্তবতা তাহলে কী? কোনো কোনো রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। আমরা এভাবে একটা ক্যাম্পে তাদের আটকে রাখব, তারা বিরামহীনভাবে জনসংখ্যা বাড়াতে থাকবে, নাকি অন্য কোনো উদ্যোগ নেব, যেন মিয়ানমার তাদের ফেরত নিতে বাধ্য হয়, তার কোনো কিছুই পরিষ্কার নয়।
অল্পসংখ্যক রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত নেবে, এমন কথা কয়েকবার বলা হলেও সেখানে নিরাপত্তার অজুহাত তুলে তারা ফিরতে চায় না। নিরাপত্তার সংকটের কথা যতটা না রোহিঙ্গাদের, তার চেয়ে বেশি শরণার্থী নিয়ে কাজ করে এমন সাহায্যকারী সংস্থাগুলোর।
রোহিঙ্গারা যাবে না, এটা তাদের এক শক্ত মনোজগৎ। আর ইউএনএইচসিআর, ইউনিসেফসহ যেসব আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সংস্থা রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করে, তাদের অনেকের কাছে শরণার্থী ‘বিশেষ’ উপকরণ। যে শরণার্থী পৃথিবীর যেখানে ঢুকেছে, সেখানে তাদের স্থায়ী আবাস হয়েছে এদের কারণে।
তিন বছরের বেশি সময় আগে রোহিঙ্গারা যখন লাখে লাখে আসছিল, তখনই বোঝা যাচ্ছিল আমরা সীমান্ত খুলে দিয়ে, দুই বাহু বাড়িয়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে যে এদের গ্রহণ করছি, তা প্রশ্নবিদ্ধ। স্পষ্ট হয়েছিল এর নিকটবর্তী কোনো সমাধান নেই। আমি তখন বলেছিলাম, ‘রোহিঙ্গারাই হবে আজ এবং আগামীর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা।’
আসলে যেটি প্রথম কাজ ছিল তা হলো, প্রথম দফায় রোহিঙ্গা দলটি আসার পরপরই সীমান্তে কড়া পাহারা বসিয়ে পুশব্যাক করে মিয়ানমারকে কড়া বার্তা দেওয়া। দেশের যেসব বুদ্ধিজীবী ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আমাদের মানুষের আশ্রয় নেওয়ার সঙ্গে এদের তুলনা করেন, তাঁদের উদ্দেশে শুধু বলব—বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিল এবং যুদ্ধে জয়ী হয়ে নাগরিকদের নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে এনেছে।
জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো জনমতই তৈরি করতে পারেনি। এরা আমাদের প্রকৃতি ধ্বংস করেছে, করে চলেছে এবং এরা আমাদের জন্য বড় সামাজিক সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে আমরা নানাবিধ সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছি। অবিলম্বে এ সংকটের সমাধানও দেখছি না। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর লাগাতার আক্রমণে সারা বিশ্ব স্তম্ভিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কেউ আমাদের পাশে সেভাবে দাঁড়ায়নি। চীন আর রাশিয়া সরাসরি মিয়ানমারের পক্ষে থেকেছে, ভারত মিয়ানমারকে হাতে রেখেছে, আমাদের প্রতিও কিছুটা মানবিকতা দেখিয়েছে। পশ্চিমা সম্প্রদায়ও রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষে বড় অবস্থান নেয়নি। আর ওআইসি বা ইসলামিক দেশগুলোর কাছে সেভাবে কোনো প্রত্যাশাও ছিল না এবং তারা সেটা করেওনি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন বহুবার বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমার সৃষ্টি করেছে এবং সমাধান তাদেরই করতে হবে। এ ছাড়া তিনি বলেছেন, বিশ্বকে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। কূটনৈতিক ভাষা হিসেবে এ কথা সুন্দর, কিন্তু ফলপ্রসূ নয়। বাংলাদেশ শুরু থেকেই একটি পরিষ্কার ও দৃঢ় অবস্থান বিশ্বকে জানাতে পারেনি, পারেনি তার নিজ দেশের মানুষকেও জানাতে। বিশ্বকে, মিয়ানমারকে জানান দেয়নি, ‘এদের আর আমরা রাখতে পারছি না।’
রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে সুবিধাভোগী একটি অংশ তৈরি হয়েছে। এরা এ সংকট থেকে নানাভাবে লাভবান হচ্ছে। অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার দৃষ্টিভঙ্গিও এ সংকটের সমাধান-পরিপন্থী। কারণ, তাদেরও সুবিধার বিষয় রয়েছে। এসব কারণে রোহিঙ্গা সংকট জটিল আকার ধারণ করছে। কতগুলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করার যেকোনো প্রক্রিয়াকে বারবার বাধা দিয়েছে। তারা যেটা বলেছে, রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার, মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে; সেটা অবশ্যই আদর্শিক অবস্থান থেকে যুক্তিসংগত। কিন্তু এটাও বুঝতে হবে, শুধু তাত্ত্বিক ও আদর্শিক অবস্থানে থেকে বিশ্বের কোথাও শরণার্থী সংকট নিরসন সম্ভব হয়নি।
রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমে ফেরাতে বাংলাদেশ যদি কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তবে এ দেশের ভবিষ্যৎ ও সম্ভাবনার ওপর প্রভাব পড়বে। তিন বছর পর কূটনীতিতে আরো সচল আর সক্রিয় প্রক্রিয়া দেখব কিনা, তার অপেক্ষায় দেশের মানুষ।
লেখক : সাংবাদিক