শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্তে বিলম্ব কেন?
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশ এরই মধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তবে পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রে জরুরি অবস্থা জারিসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সর্বস্তরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়ে জোর দাবি জানানো হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের পরিস্থিতি এখনো বাংলাদেশে হয়নি। অনেক অভিভাবক নিজ উদ্যোগেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানকে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন। এ কারণে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কমে যাচ্ছে।
খুব স্বাভাবিকভাবেই সবার মনে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর কি বন্ধ করা হবে? কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি করোনা আক্রান্ত একজনকেও পাওয়া যায়, তাহলে কোয়ারেন্টিনে যেতে হবে প্রায় সবাইকে। এ ক্ষেত্রে আশঙ্কা করা হচ্ছে, ছোট শিশুদের কীভাবে কোয়ারেন্টিনে নেওয়া হবে, তারা কি বাবা-মা ছাড়া একা থাকতে রাজি হবে, হোম কোয়ারেন্টিনেও কি শিশুদের দিয়ে সম্ভব হবে? সরকার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে স্কুল বন্ধ না করে মাঠে অ্যাসেমব্লি না করে শ্রেণিকক্ষে আয়োজনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে একটি সচেতনতামূলক বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে। এমন বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও।
অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে করোনাভাইরাসের রোগ প্রতিরোধে জনসমাগম এড়িয়ে চলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাসরুমেও কি কম জনসমাগম হয়? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গণপরিবহনে চড়ে আসেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকায় স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনা পালন করা শিক্ষার্থীদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। আবাসিক হলে প্রতিটি কক্ষে চার-পাঁচজন করে থাকেন। আর গণরুমে থাকেন ৬০ থেকে ১০০ জন। ফলে একজন অসুস্থ হয়ে পড়লেও অন্য সবার অসুস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
তা সত্ত্বেও আমরা ভাবছি, করোনা ছড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশের কী অবস্থা হবে। ভাবতেই আঁতকে উঠছি। আমাদের এই মহাবিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে সরকারের এখনই গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করাসহ রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক জনসমাবেশ এখনই বন্ধ না করলে আমাদের ভাগ্যে বড় বিপর্যয় নেমে আসবে। এই পর্যন্ত যারা এ ভাইরাসকে অবহেলা করেছে, তারাই আজ আক্রান্ত। তবে আমি খুবই আতঙ্কিত; কারণ, সারা বিশ্ব যখন করোনাভাইরাস মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছে; প্রতিটি রাষ্ট্র যেখানে ধার্মিক, অধার্মিক, সরকারি দল, বিরোধী দল, বুদ্ধিজীবী সবাই এক কাতারে এসে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করছে, সেখানে আমাদের দেশে এ নিয়ে চলছে রাজনীতি। ভিন্ন দলের ভিন্নমত। তারা এই দুর্যোগকালেও এক হতে পারছে না।
বেশ কয়েক দিন থেকে শুনছিলাম, শিশুরা করোনায় আক্রান্ত হবে না। কিন্তু আজ সকালেই কোনো একটি সংবাদ থেকে জানলাম, নবজাতক একজন শিশু করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। তবে জানা গেছে, এ ভাইরাসে মূলত ১৮ থেকে ৩৫ বছরের ব্যক্তিরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা সবাই এই বয়সসীমার মধ্যে রয়েছে। আমার ক্লাসে প্রতিদিন ১১০ শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকে। বহু শিক্ষার্থীর সর্দি-কাশি রয়েছে। তাদের নিশ্চয়ই শ্রেণিকক্ষ থেকে আমি বের করে দিতে পারছি না। কারণ তাদের অধিকার রয়েছে ক্লাসে বসে থাকার। প্রকৃতপক্ষে শিশু-কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ কেউই করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকার গ্যারান্টি দিতে পারবে না। পরিস্থিতি কোনোভাবেই অনুকূলে নেই।
অবশ্য আমরা খুব সচেতনভাবেই সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে দেখছি। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ইস্যুতে এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার দাবিতে আন্দোলনে নামলেও এ বিষয়ে সরকারকে কোনো ভ্রূক্ষেপ করতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ও গুজব তৈরি হচ্ছে। এমনকি ইস্যুটিতে রাজনীতির ফ্লেভার দেওয়া হচ্ছে। আমি মনে করি, এটি একটি আন্তর্জাতিক মহামারি। এ সমস্যা মোকাবিলায় সকল সম্ভাব্য সমাধান গ্রহণ করা উচিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাময়িক বন্ধ করলে কোনোভাবেই দেশ ও জাতির বড় কোনো ক্ষতি হবে না; বরং সবার দাবি সত্ত্বেও সেটি আমলে না নেওয়ায় পরে করোনাভাইরাস নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটে গেলে তার মাশুল আমাদের সবাইকে দিতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়