শিক্ষার্থীর স্বপ্ন, ভালো ফল এবং পরিণতি
বাংলাদেশে মাধ্যমিকের ফলাফলকে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গত বেশ কয়েক বছরের মাধ্যমিকের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতি বছর ক্রমেই আগের বছরের তুলনায় ফলাফল ভালো হচ্ছে, যা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য ইতিবাচক সংকেত। প্রাসঙ্গিকভাবেই মাধ্যমিকে সদ্য ফলাফলধারী শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য, ভবিষ্যৎ ও করণীয় নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই কম-বেশি চিন্তিত। এ ধরনের চিন্তার মূল কারণ হলো ভালো ফলাফলের ব্যাপকতা। আমাদের দেশে যেভাবে প্রত্যাশিত ফলাফল নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবক উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখছেন, সেভাবে অনেক ক্ষেত্রেই তা পূরণ হচ্ছে না। এ জন্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ধরন এবং এর বাস্তবমুখী প্রয়োগ ও সুযোগের পদ্ধতিগত দিককেই দায়ী করা যায়। প্রতি বছরই মাধ্যমিক পরীক্ষায় শতকরা হিসেবে প্রায় ৯০ জনের বেশি পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়। এ সংবাদ দেশের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক। এ ছাড়া এসব শিক্ষার্থীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জিপিএ ৫ পাওয়ার গৌরব অর্জন করে।
শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকদের বেশির ভাগই পর্যায়ক্রমে পিইসি, জেএসসি এবং এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের সঙ্গে সঙ্গে একটি স্বপ্ন লালন করতে শুরু করেন, যার প্রথম হোঁচটটি খায় উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে আশানুরূপ প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পেরে। তবে হ্যাঁ, প্রতিযোগিতার বাজারে সবাই পছন্দের এবং প্রত্যাশিত প্রথম জায়গাটিতে বসতে পারবে এমন কথাও ঠিক নয়। কিন্তু যদি জিপিএ ৫ পাওয়া সর্বোচ্চ ফলধারী কোনো শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জায়গা করে নিতে না পারে, তাহলে রাষ্ট্রের কাছে তার আর চাওয়া কী থাকতে পারে?
সাধারণত যেসব শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে জিপিএ ৫ পায়, তারা উচ্চমাধ্যমিক পাস করে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোর মধ্যে কোনো একটিতে জায়গা করে নিতে চায়। এটি খুব স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখজনক হলো, উভয় পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়া এসব শিক্ষার্থীর সংখ্যার অনুপাতে ভালো বা কাঙ্ক্ষিত বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশে পর্যাপ্ত নেই। শুধু তা-ই নয়, উচ্চমাধ্যমিক কিংবা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। সাধারণত দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও প্রাপ্তির যথাযথ সমন্বয় না ঘটলে সেখানে সৃষ্টি হয় চরম হতাশা। আর এমন হতাশাই সৃষ্টি করে সমাজে নানাবিধ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার।
আমাদের দেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী তাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমন্বয় ঘটাতে সক্ষম হয় না। তবে এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরাই ব্যর্থ, না কি দেশের প্রচলিত ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা? একজন শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে অধ্যয়ন শেষে চাকরির বাজারে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে। তখন তার সামনে বড় চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি হয়। অনেকের জীবনই হোঁচট খায় কিংবা অনেকেই কাঙ্ক্ষিত ধাপে পৌঁছাতে পারে না। তাহলে এই সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রের অধিকর্তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, ধীরে ধীরে লালন করা এই স্বপ্ন যখন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, তখন এর পরিণতি কী?
কাজেই ওইসব মেধাবী সন্তানের যথাযথ মর্যাদা দানে একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়া সৃষ্টির জোরালো পদক্ষেপ সরকারের গ্রহণ করা উচিত। একজন শিক্ষার্থী তার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির যেন একটি কাছাকাছি সমন্বয় ঘটাতে পারে, সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ রাখা এবং এ লক্ষ্যেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় থেকে শুরু করে শিক্ষার সব স্তরে শিক্ষার প্রায়োগিক দিকের গুণগত মান নিশ্চিত করা। শুধু ভালো ফলাফলের পরিমাণগত মাত্রা না বাড়িয়ে সত্যিকার অর্থেই মেধাবী সন্তানদের দিয়ে জাতিকে পুনর্গঠন করতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলকে সচেতন হতে হবে। আর এই সচেতনতাই সমাজ, রাষ্ট্র ও শিক্ষাব্যবস্থাকে দৃঢ়তার সঙ্গে টিকিয়ে রাখতে পারবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্রফেশনাল স্টাডিজ