সংক্রামক রোগ মোকাবিলায় আইনের বিধিবিধান
পৃথিবীব্যাপী নভেল করোনাভাইরাস বিপর্যয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ এই বৈশ্বিক বাস্তবতার বাইরে নয়। ইতোমধ্যে কমিউনিটি লেভেলে এই ভাইরাসের বিস্তার বাংলাদেশেও দেখা দিয়েছে। এরূপ অবস্থায় জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে সংক্রামক রোগ বিষয়ে সরকারের কী প্রকারের দায়-দায়িত্ব রয়েছে এবং জনসাধারণের কী প্রকার আইনি বিধিনিষেধ মেনে চলা উচিত, তা জানা ও বোঝা আবশ্যক।
জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবিলা ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হ্রাসের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সালে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন প্রণয়ন করে। এই আইনের ৪ ধারায় সংক্রামক রোগ অর্থে (ক) ম্যালেরিয়া; (খ) কালাজ্বর; (গ) ফাইলেরিয়াসিস; (ঘ) ডেঙ্গু; (ঙ) ইনফ্লুয়েঞ্জা; (চ) এভিয়ান ফ্লু; (ছ) নিপাহ; (জ) অ্যানথ্রাক্স; (ঝ) মার্স-কভ (MERS-CoV); (ঞ) জলাতঙ্ক; (ট) জাপানিজ এনকেফালাইটিস; (ঠ) ডায়রিয়া; (ড) যক্ষ্মা; (ঢ) শ্বাসনালির সংক্রমণ; (ণ) এইচআইভি; (ত) ভাইরাল হেপাটাইটিস; (থ) টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধযোগ্য রোগসমূহ; (দ) টাইফয়েড; (ধ) খাদ্যে বিষক্রিয়া; (ন) মেনিনজাইটিস; (প) ইবোলা; (ফ) জিকা; (ব) চিকুনগুনিয়া; এবং (ভ) সরকার কর্তৃক, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, ঘোষিত কোনো নবোদ্ভূত বা পুনরুদ্ভূত (Emerging or Reemerging) রোগগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সম্প্রতি আবিষ্কৃত হওয়ায় এই আইনে রোগের তালিকায় করোনাভাইরাসের উল্লেখ নেই। তবে এই আইনের ৯ ধারায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিধিবিধান অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization) কর্তৃক, প্রকাশিত এবং তফসিলে উল্লিখিত International Health Regulations, প্রয়োজনীয় অভিযোজনসহ, সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রয়োগযোগ্য হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসকে pandemic ঘোষণা দিয়েছে। এ ছাড়া কিছুদিন আগে মহামান্য হাইকোর্ট করোনাকে সংক্রামক রোগ হিসেবে গেজেটে প্রকাশের নির্দেশনা দিয়েছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আইনটি করোনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলা যায়।
এ আইনের ৫ ধারায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে কর্মকৌশল প্রণয়নসহ, সচেতনতা বৃদ্ধি, সংক্রমিত এলাকাকে সংক্রমণমুক্ত এলাকা থেকে পৃথককরণ, প্রাদুর্ভাব ও পুনরাবির্ভাব রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ, চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের অপব্যবহার রোধ, রোগের সংক্রমণের আধার হিসেবে বিবেচিত হলে ওই স্থান বা স্থাপনা পরিদর্শন ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক ও ল্যাবরেটরি পরীক্ষা, প্রয়োজনে, অ্যান্টিবায়োটিক, প্রতিষেধক টিকা বা ওষুধ প্রয়োগ, রোগে আক্রান্ত হয়েছেন এরূপ কোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট হাসপাতাল, অস্থায়ী হাসপাতাল, স্থাপনা বা গৃহে অন্তরীণ (Quarantine) রাখা বা পৃথককরণ (Isolation), জীবাণুঘটিত দূষণ প্রতিরোধ ও রোগ সংক্রমণের উৎস অপসারণ বা ধ্বংসকরণ, সংক্রামক রোগের বিস্তার রোধে বাজার, গণজমায়েত, স্টেশন, বিমানবন্দর, নৌ ও স্থলবন্দরগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা, সংক্রামণ রোধে উড়োজাহাজ, জাহাজ, জলযান, বাস, ট্রেন ও অন্যান্য যানবাহন দেশে আগমন, নির্গমন নিষিদ্ধকরণসহ নানাবিধ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে।
আইনের ১১ ধারা অনুযায়ী অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে, আদেশ দ্বারা, যেকোনো আক্রান্ত এলাকাকে সংক্রমিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করিতে পারিবেন। আইনের ১৪ ধারার বলে কোনো সংক্রমিত ব্যক্তিকে বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে, সাময়িকভাবে অন্য কোনো স্থানে স্থানান্তর বা জনবিচ্ছিন্ন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ধারা ২২ অনুসারে সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে, এই প্রকারের কোনো দ্রব্যাদি আমদানি বা রপ্তানি বন্ধের বিধান রাখা হয়েছে।
সরকারের পাশাপাশি রাষ্ট্রের নাগরিকেরও কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলার বিধান রাখা হয়েছে এই আইনে। যদি কোনো ব্যক্তি সংক্রামক জীবাণুর বিস্তার ঘটান বা বিস্তার ঘটাতে সহায়তা করেন, বা জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও সংক্রমণের ঝুঁকির বিষয়টি গোপন করেন, তা হলে উক্ত ব্যক্তি আইনের ২৪ ধারামতে অপরাধী হবেন এবং অনূর্ধ্ব ৬ (ছয়) মাস কারাদণ্ডে, বা অনূর্ধ্ব ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
যদি কোনো ব্যক্তি—মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তাঁর ওপর অর্পিত কোনো দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করেন এবং ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কোনো নির্দেশ পালনে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন, তা হলে আইনের ২৫ ধারা অনুযায়ী অনূর্ধ্ব ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে, বা অনূর্ধ্ব ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
এ ছাড়া মিথ্যা বা ভুলতথ্য প্রদানের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে আইনের ২৬ ধারায়। কোনো ব্যক্তি যদি সংক্রামক রোগ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বা ভুল তথ্য প্রদান করেন তা হলে অনূর্ধ্ব ২ (দুই) মাস কারাদণ্ডে, বা অনূর্ধ্ব ২৫ (পঁচিশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এখানে উল্লেখ্য, করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই কিছু কিছু মাধ্যমে গুজব কিংবা ভুলবশত সংক্রমণের মাধ্যম হিসেবে গবাদি পশু, গৃহপালিত পশু ও পোষ্য প্রাণীকে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে করে উল্লেখিত প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতার ঝুঁকি রয়েছে। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক মাধ্যমে পশু-পাখি কর্তৃক করোনাভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা নাকচ করা হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কোনো ধারণা বা ভুল তথ্যের ভিত্তিতে কোনো প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা দেখানো হলে প্রাণীকল্যাণ আইন, ২০১৯ অনুসারে সর্বোচ্চ দুই বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড হতে পারে। এ ছাড়া পোষ্য প্রাণী প্রতিপালনের জন্য যদি কোনো বাড়ির মালিক তাঁর ভাড়াটিয়াকে বাড়ি ছাড়ার কিংবা প্রাণী ফেলে দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন, তাহলে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে করোনাভাইরাস নিয়ে মিথ্যা রটনা, গুজব কিংবা সরকারের বা ব্যক্তির সম্মানহানি বা ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করেন, তাহলে ডিজিটাল আইনেও ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
করোনা একটি বৈশ্বিক বিপদ। বাংলাদেশও এর পরিস্থিতির স্বীকার। তবে সরকার এই সংক্রমণ রোধে যথাযথ পদক্ষেপ নিলে এবং জনসাধারণ সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে সচেতন থেকে বিধিনিষেধ প্রতিপালন করলে এই দুর্যোগের সম্ভাব্য ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। আতঙ্ক সৃষ্টিকারী ও মিথ্যা তথ্য প্রচার বন্ধ করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহের সঠিক, সময়োপযোগী ও সমন্বিত পদক্ষেপ।
লেখক : ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট