সোহাগী ‘পেঁয়াজ’
বাজারে জলপাই উঠেছে। জলপাই দেখার প্রয়োজন হয় না শুনলেই জিভে জল আসে। এই যেমন লিখতে গিয়েই জল পড়ে যায়। আজ তেমন হচ্ছে না। বাজারে গিয়েও তাই হলো। জলপাই দেখছি কিন্তু জিভ শুকনো। কত বড় আকারের জলপাই। ভাবলাম শরীর ও মনের কোথাও চ্যুতি ঘটেছে। সরে গিয়ে অন্য কেনাকাটায় মনোযোগী হলাম। আচমকা দেখি, মুখগহ্বর-জিভ রসে টলমল। জলে বান ডেকেছে। কেন? জলপাই প্রতিক্রিয়া কি দেরিতে শুরু হলো? নিজেকে আমি পেঁয়াজের দোকানের সামনে আবিষ্কার করলাম। পেঁয়াজ কুটলে ঝাঁজে চোখে জল আসে। সেই জল জিভ গড়িয়ে পড়ছে কেন? তা-ও আবার লাবণ্যহীন পেঁয়াজ। ত্বক কেমন কালো। চর্মরোগ হলো নাকি? দগদগে এই চেহারা নিয়েই নাকি ডাবল সেঞ্চুরি মেরে দিল। এখন ধীরে ধীরে এগোচ্ছে তৃতীয় শতক গড়ার দিকে। ব্রায়ান লারার বুকে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে, পেঁয়াজ রের্কড ছুঁলো বলে। এই যে পেঁয়াজের এত বড় পারফরম্যান্স, তার কোনো দামই দিচ্ছেন না বাণিজ্যমন্ত্রী! বলেই যাচ্ছেন পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে আছে। বাজারের যাঁরা দর্শক, তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন পেঁয়াজ সাধ্যের সীমানা পেরিয়ে যাচ্ছে।
পেঁয়াজের এই পারফরম্যান্সের পেছনে আছে কূটনীতির প্রণোদনা। ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি নিষিদ্ধ করার পর বাড়তি বাজার ওভার বাউন্ডারি হাঁকানোর সুযোগ পায়। ৫০, ৭০, ৮৯, ৯০, ১০০ এভাবে ২৫০-এ এসে ঠেকেছে। পেঁয়াজের দামের গতি ঠেকাতে সরকার পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারের নির্দেশ বা আহ্বানে মিয়ানমার, তুরস্কসহ নানা দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু করে ব্যবসায়ীরা। কিছু পেঁয়াজ এসেছে, বাকি পেঁয়াজ এখনো সাগরে। জাহাজ নোঙর করতে সময় নেবে। এই সুযোগে ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজকে আঙুর, আপেল, বেদানার ওপরে নিয়ে তুলেছে। সরকারে একাধিক দপ্তরের অভিযানও তাদের মনে ভয় ধরাতে পারেনি। কাউকে তোয়াক্কা বা সমীহ না করেই ব্যাট চালাচ্ছে তারা। জাতীয় সংসদে পেঁয়াজ নিয়ে আলোচনায় যাঁরা পেঁয়াজ নিয়ে খেলছেন, তাঁদের বন্দুকযুদ্ধে দেওয়ার দাবিও উঠেছে।
সংসদ সদস্য হয়তো ক্ষোভের উচ্চতা বোঝাতে বন্দুকযুদ্ধের কথা বলেছেন। জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে জনমানুষের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে, এ কথা বলা যায়। অর্থনীতি মেনে কথা বললে বলতে হবে বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহের সংকট তৈরি হয়েছে। সরবরাহ-সংকট তৈরি হবে কেন? বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পেঁয়াজের চাহিদার অঙ্কটি জানা থাকার কথা। সে হিসেবে স্থানীয় উৎপাদন ও আমদানির মধ্যে সমন্বয় থাকার কথা। সেই সমন্বয়ের ছক এবার কাজ করেনি। আমরা অতীতে ফিরে গেলে দেখব, স্থানীয় উৎপাদন কম হলে বা আমদানির ছন্দপতন ঘটায় আগেও বহুবার পেঁয়াজ বছরের আলোচিত চরিত্র হয়ে উঠেছিল। তবে এবার ভেঙে গেছে সর্বকালের রেকর্ড। বিশ্বজুড়েই পেঁয়াজের দাম এবার অন্য সময়ের চেয়ে বেশি। তবে যে দেশ থেকেই পেঁয়াজ আমদানি করে নিয়ে আসা হোক না কেন, সেই পেঁয়াজের দাম খুচরা বাজারে সর্বোচ্চ ষাট টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাংলাদেশে চারগুণের চেয়েও বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। শুধু যে ভারত থেকে আমদানি বন্ধ হওয়ায় এমনটা হয়েছে, তা বলা যাবে না। আমদানিকারক ও কমিশন এজেন্টদের যৌথ কৌশল কাজ করছে এখানে। তারা বাজারের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে বাড়তি মুনাফা করে নিচ্ছে। তাদের এই কৌশলের কাছে সরকারের সব ধরনের অভিযান ভেস্তে গেছে। সামনে বাজারে দেশি পেঁয়াজ আসতে শুরু করবে। তখন পেঁয়াজে পাগলা ঘোড়ার গতিতে টান পড়বে। বাণিজ্যমন্ত্রী হয়তো সেই প্রহরই গুনে যাচ্ছেন। কিন্তু পেঁয়াজ জনমনে যে ক্ষোভের ঝাঁজ ছড়িয়ে গেল, তা নেভানো কি খুব সহজ হবে, কারো চোখের জল গড়িয়ে পড়বে না তো? আকাশপথে পেঁয়াজ এনেও সেই জল সামাল দেওয়া যাবে তো?
লেখক : বার্তাপ্রধান, সময় টিভি