আলেপ্পোর সেই ‘ট্যুইটিং গার্ল’
বেশ কিছুদিন আগে ভূমধ্যসাগরের উপকূলে শিশু আয়লানের নিথর দেহ পড়ে থাকার দৃশ্য এবং সিরিয়ার আলেপ্পোয় বিমানহানার পরে ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা ওমরানের রক্তাক্ত শরীরের সেই দৃশ্যই সিরিয়ায় বিপন্ন মানবতার কথা সারা বিশ্বের মানুষকে জানান দিয়েছিল। দুই শিশুর ছবি এবং ভিডিও সেদিন নাড়িয়ে দিয়েছিল পুরো বিশ্ববিবেককে। কিন্তু তারপরও থামেনি সিরিয়ায় বোমাবর্ষণ।
এমনই প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে আরো এক শিশুকন্যা। সাত বছরের এই শিশুর নাম বানা আল-আবেদ। ছোট এই শিশু ক্ষমতা দখল, আধিপত্য বিস্তার আর অস্ত্র বাণিজ্যের নামে মানুষ মারার খেলা বন্ধের আহ্বান জানাতে, বেছে নিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ট্যুইটার।
এই বয়সে তাঁর খেলায় মাতোয়ারা হয়ে থাকার কথা। স্কুল আর পরিবারের অন্দরে ছুটে বেড়ানোর কথা।
কিন্তু বুলেট আর বোমা কেড়ে নিয়েছে বানার শৈশব। নিষ্পপ এই শিশু প্রতিনিয়তই জন্মভূমি আলেপ্পো শহরে দেখেছে মৃত্যুর মিছিল। আর স্বজনহারা কান্না। তাই অস্বাভাবিক এই জীবনই বানাকে প্রতিবাদী করে তুলেছে। প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
বানা আল আবেদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ট্যুইটারের সাহায্যে নিয়মিত বিশ্ববাসীর সামনে তুলে এনেছিল পূর্ব আলেপ্পোর ভয়াবহতা। যুদ্ধ বন্ধের আহ্বানও জানিয়েছে সেই ট্যুইট বার্তায়। এতে সহায়তা করছেন তার মা ‘ফাতেমা’। এরই মধ্যে যা ঝড় তুলেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। মাত্র এক মাসে বানার ফলোয়ার সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২,৩৩,৮৪৯। ট্যুইট বার্তায় বানা জানিয়েছে, ‘তার মতো এমন হাজারো শিশু যেতে পারছে না স্কুলে। বানা আকুতি জানিয়ে লিখেছে, তার মতো আলেপ্পোর হাজার হাজার শিশু জঙ্গি নয়। তাদের ওপর যেন আর বোমা না ফেলা হয়।‘ তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়ির ছবিও ট্যুইট করেছে।
আর এ খবর জানার পর বানার সঙ্গে দেখার করার আগ্রহ প্রকাশ করেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। বুধবার (২১ ডিসেম্বর) প্রেসিডেন্ট ভবনে গেলে তিনি বানাকে জড়িয়ে ধরেন। এমনকি বানা ও তার ভাইকে কোলে তুলে নেন এরদোয়ান। এ সময় পাশে ছিলেন প্রেসিডেন্টের স্ত্রী এমিনি। বুধবার এএফপির এক খবরে এ তথ্য জানানো হয়।
প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে ফিরে বানা টুইটার বার্তায় লিখে, ‘মি. এরদোয়ানের সঙ্গে দেখা করে খুব ভালো লাগছে।’ তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যস্থতায় বিদ্রোহীরা যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার পর আলেপ্পো থেকে হাজারো সাধারণ মানুষের সঙ্গে বানার পরিবারও সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ পায়। গত সোমবার (১৯ ডিসেম্বর) বানা আলেপ্পো ছাড়ে।
তখনই তুরস্কের কর্মকর্তারা আশ্বাস দেন যে বানা ও তার পরিবার চাইলে তুরস্কে আসতে পারে। তবে কবে তারা তুরস্কে গেছে, তা জানা যায়নি। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট কার্যালয় জানায়, বানা এরদোয়ানকে বলেছে, ‘আলেপ্পোর যুদ্ধের হাত থেকে শিশুদের রক্ষা করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি।’ এ বিষয়ে এরদোয়ান নিজের টুইটারে লিখেছেন, ‘আজ প্রেসিডেন্ট প্যালেসে বানা ও তার পরিবারকে আমন্ত্রণ জানাতে পেরে ভালো লাগছে। তুরস্ক সব সময়ই সিরিয়াবাসীর পাশে আছে।’
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তিন লক্ষেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৫ হাজারই শিশু। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় সবচেয়ে বড় বিপদের মুখে শৈশব। কেউ অকাতরে প্রাণ হারাচ্ছে। কারো স্থায়ী শারীরিক ক্ষতি হচ্ছে। যাদের ক্ষতি শারীরিক নয়, এক দুর্বিষহ পরিস্থিতি মানসিকভাবে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে তাদের।
কিন্তু এখন নতুন প্রশ্নের উদয় হয়েছে। কোথায় যাবে বানা ও তাঁর পরিবার? মাথার উপর ছাদটুকুও যে নেই আজ। নতুন বছরে পা দেয়ার আগেই বানা আল আবেদদের গায়ে ইতোমধ্যে লেগে গিয়েছে ‘শরণার্থী’ নামক তকমা।
লেখক : শিক্ষার্থী, স্টেট ইউনির্ভাসিটি