কোন দিকে বিশ্ব রাজনীতি
মার্কিন নির্বাচন-পরবর্তী বিশ্ব রাজনীতিতে ভিন্ন গতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে ওবামা ও ট্রাম্প দ্বন্দ্ব বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। প্যালেস্টাইন ভূখন্ডে ইসরায়েলের অবৈধ বসতি স্থাপনবিরোধী জাতিসংঘ-প্রস্তাব পাসের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৩৭ বছর পর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো প্রস্তাবে ভেটো দেওয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরত থাকার বিষয়টি সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।
ইসরায়েল অভিযোগ করেছে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ওবামা এ প্রস্তাব পাসের নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছেন। অবশ্য ওয়াশিংটন এ অভিযোগ অস্বীকার করলেও ওবামা অবৈধ বসতি স্থাপন বন্ধের প্রতি তাঁর অঙ্গীকারের কথা আবারও স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন। তবে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক কট্টর জায়নবাদীকে ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন এরই মধ্যে। অবশ্য ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারণার সময় বলেন, জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নেবেন। আর জাতিসংঘে অবৈধ বসতি স্থাপনবিরোধী প্রস্তাব পাসের পর তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ২০ তারিখ তাঁর শপথের পর জাতিসংঘ নতুন করে ভাববে। প্যালেস্টাইন ও ইসরায়েল বিষয়ক পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ওবামা ও ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান একেবারেই পরস্পরের বিপরীত।
এমন দ্বন্দ্বময় পরিস্থিতিতে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন, তার দায়িত গ্রহণের পর পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। টুইটারে তিনি লিখেছেন, ‘২০ জানুয়ারির পর পরিস্থিতি ভিন্ন হবে।’ যদিও ধারণা করা যায় যে, প্রেসিডেন্ট ওবামার এই সিদ্ধান্ত ট্রাম্পকে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বড় ধরনের সংকটে ফেলতে পারে। এমনকি বিশ্ব রাজনীতিতে এক ধরনের নিরাপত্তার সংকট তৈরি হতে পারে। এমন প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প দায়িত্ব নিয়ে তার মন মতো অবস্থানে ফিরে আসা কতটা সহজ হবে সেটি এখন চিন্তার বিষয়।
অন্যদিকে ইতিমধ্যেই আমরা লক্ষ করেছি বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদের নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। কিন্তু এ তালিকায় বাদ পড়েছেন বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তাঁর স্থলে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকেই নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানান তিনি। এভাবে নানামুখী অবস্থায় একটি টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে বিশ্ব রাজনীতিতে। আর এ উত্তেজনা প্রশমনের ক্ষেত্রে কি শুধু ট্রাম্পের দায়িত্ব নেওয়াটাই যথেষ্ট নাকি অন্য কোনো সমীকরণ থেকে যাবে সেটি এখন বিশ্ববাসীর আগ্রহের বিষয়। ট্রাম্প ২০ জানুয়ারি ওবামার কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব বুঝে নেবেন। কিন্তু এরই মধ্যে তিনি বেশ কয়েকবার পুতিনের প্রশাসনের প্রশংসা করেছেন। আর নিজ মন্ত্রিসভায় এমন ব্যক্তিদের বেছে নিয়েছেন, যাঁরা রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ।
উল্লেখ্য, নির্বাচনী প্রচারের সময় ট্রাম্প বারবার বলেছেন, অভিবাসী বিশেষ করে মুসলিম অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। সন্ত্রাসে জর্জরিত মুসলিম রাষ্ট্রগুলো থেকে আসা অভিবাসীদের বের করে দেওয়া হতে পারে এমন কথাও বলেছেন তিনি। এমন আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে ওবামা প্রশাসন সন্ত্রাসে জর্জরিত মুসলিম দেশ থেকে আসা লড়াই করার বয়সে রয়েছে এমন যুবকদের খুঁজে বের করার প্রকল্প বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে। যদিও এই প্রশাসন দীর্ঘদিন থেকেই এ প্রকল্প চালিয়ে আসছিল।
গত ৩০ ডিসেম্বর টুইটারে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘দেরি করে (পুতিন) অসাধারণ কাজ করেছেন, আমি বরাবরই তাঁকে অত্যন্ত স্মার্ট হিসেবে জানি!’ ওয়াশিংটনের রুশ দূতাবাস তাৎক্ষণিকভাবে ট্রাম্পের ওই মন্তব্য প্রচার করেছে। অন্যদিকে রিপাবলিকান নেতা ও সিনেটের আর্মড সার্ভিসেস কমিটির চেয়ারম্যান জন ম্যাককেইন ৩০ ডিসেম্বর বলেছেন, সাইবার হামলার ঘটনায় রাশিয়াকে মাশুল দিতেই হবে। কোনো দেশের বিরুদ্ধে হামলা যুদ্ধ করারই শামিল। ‘মার্কিন স্বার্থবিরোধী চেষ্টার’ অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র গত ২৯ ডিসেম্বর ৩৫ জন রুশ গোয়েন্দাকে বহিষ্কার এবং দুটি রুশ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। জবাবে মার্কিন কূটনীতিকদের রাশিয়া থেকে তাৎক্ষণিকভাবে বহিষ্কারের সম্ভাবনা পুতিন নাকচ করে দিয়েছেন। কম্পিউটার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে মার্কিন নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের অভিযোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত ৩১ তারিখ আবারও সন্দেহ জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে ওই অভিযোগ করেছে। তার ভিত্তিতে ওয়াশিংটন রুশ কূটনীতিক বহিষ্কারের
এক্ষেত্রে ট্রাম্পের যুক্তি, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আগেও ভুল করেছিল। তারাই ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার তথ্য দিয়েছিল, যার ভিত্তিতে ২০০৩ সালে দেশটিতে মার্কিন বাহিনী হামলা করেছিল। সেই যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে বিপর্যয় ডেকে আনে।
বর্তমান অবস্থায় লক্ষ করা যাচ্ছে যে, ফিলিস্তিন ইস্যুতে ক্রমেই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ও নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। ট্রাম্প তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের আগ পর্যন্ত ইসরায়েলকে ‘শক্ত’ থাকতে বলেছেন। আর বিপরীতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বসতি স্থাপন বন্ধ না হলে সংকট সমাধান সম্ভব নয় বলে ইসরায়েলের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
এমন অবস্থার প্রেক্ষাপটে ধরেই নেওয়া যায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নবনির্বাচিত প্রশাসন ও বর্তমান প্রশাসনের মধ্যে এক চরম দ্বন্দ্বময় অবস্থা বিরাজ করছে। আর এ দ্বন্দ্বময় অবস্থার দ্রুত সুন্দর ও নির্ভরযোগ্য সমাধান না ঘটলে ভবিষ্যতে সুষ্ঠু সমাধান টানা আদৌ সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থাকবে। বিশ্ব রাজনীতিতে সহনশীলতা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে বিদ্যমান এই টানাপড়েন এখনই বন্ধ হওয়া দরকার।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।