ভুলে ভরা পাঠ্যবই, দায় নেবে কে?
শিশুদের মৌলিক শিক্ষা শুরু হয় প্রাথমিক স্কুল থেকে। এখান থেকে শিশুরা শেখে পরিবার, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, আদব-কায়দা, নৈতিকতা, বড়দের সম্মান করা, ছোটদের স্নেহ করা, পারিবারিক সম্পর্ক এবং জীবন-জীবিকার শিক্ষা। একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়ার মৌলিক ভিত্তিই প্রাথমিক শিক্ষা। যে দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা যত বেশি সুসংগঠিত, সে দেশের সামগ্রিক উন্নতি তত বেশি টেকসই। প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার ওপরই নির্ভর করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা।
প্রতিবছর ১ জানুয়ারি সারা দেশে একযোগে সব স্কুলে বই উৎসব শুরু হয়। স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা তাদের নতুন ক্লাসের বই পায়, এতে ছেলেমেয়েদের নতুন ক্লাসে পড়ার আগ্রহ জন্মায়। আমিও ছোটবেলায় স্কুল থেকে নতুন বই পেতাম। কী যে ভালো লাগত, সে অনুভূতি সত্যিই ভোলার নয়। নতুন বই দেওয়া মাঝে বন্ধ ছিল, কিন্তু বর্তমান সরকার আবার সেটা চালু করেছে। বিনামূল্যে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা তাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের বই পাচ্ছে। সরকারের এ উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।
প্রায় ৩৬ কোটি বই ছাপানো একটা বিশাল বড় যজ্ঞ। সুতরাং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) যে ধরনের গুরুত্ব বা মনোযোগ এ বিষয়ের প্রতি দেওয়া দরকার ছিল, সেখানে হয়তো ঘাটতি ছিল। প্রতিবছরই এ ধরনের ত্রুটি বই ছাপানোর পর ধরা পড়ে; কিন্তু নতুন বছর আসতে আসতে এগুলো আবার মানসপট থেকে হারিয়ে যায়। এ বছরও সেই ধরনের দু-একটি ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ ও অন্যান্য মাধ্যমে যে সমালোচনা আসছে, তাতে ঢালাওভাবে বলা হচ্ছে অনেক ভুল ছাপা হয়েছে; কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও সে রকম নয়। বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটি ভুল হতেই পারে, সে জন্য ঢালাওভাবে সমালোচনা করাটা আমার মতে ঠিক না।
ভুল সাধারণত দুই প্রকার—ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত ভুল। যেমন কেউ যদি লিখতে গিয়ে ২ + ২ = ৫ লেখে, তাহলে ধরে নেওয়া যায় এটা অনিচ্ছাকৃত ভুল। অথবা কেউ যদি ‘ওড়না’ বানান ‘ওরনা’ লেখে, তাহলেও ধরে নেওয়া যায় এটা অনিচ্ছাকৃত ভুল। কিন্তু কেউ যদি লেখে ছাগল গাছে উঠে আম খায় এবং আঘাতের ইংলিশ Heart, তখন সেটা আর সাধারণ ভুল থাকে না। পাঠ্যবইয়ে যে ভুলগুলো করা হয়েছে সে ভুলগুলো ইচ্ছাকৃত। কোনো ছাপাজনিত ভুল এটা হতে পারে না, কারণ বই ছাপা হওয়ার পরে প্রুফ দেখা হয়। এবং যাঁরা প্রুফ দেখেন, জানামতে তাঁরা সবাই এনসিটিবির কর্মকর্তা এবং শিক্ষিত। কর্তব্যে অবহেলা, কাজে অমনোযোগী এবং অপেশাদারি মনোভাবের কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে।
কবিতার লাইন বিকৃত করা, নারী-পুরুষ, জাতি-ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ তৈরি করা এগুলো কখনো শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা হতে পারে না। বই ছাপানোর পর এ ভুলগুলো ধরা পড়েছে। কিন্তু জাতীয় পাঠ্যক্রম এমন বই, যা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত কোনোভাবেই ভুল করা চলে না। কারণ, কোটি কোটি ছেলেমেয়ে এই ভুল শিখে বড় হবে। ভুল বিষয় শিখে কখন সঠিক কাজ করা যায় না, ভুল বানান শিখলে সারা জীবন ভুল লিখবে। ভুল অঙ্ক শিখলে ফলাফলে ভুল হবে। ভুল কবিতা শিখলে কাব্যের মর্মকথা বুঝতে ভুল হবে। সর্বোপরি ভুলে ভরা জীবনের সৃষ্টি হবে। তাই শিশু-কিশোরদের বইয়ে ভুল না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। পাঠ্যবইয়ে ভুল এমন ধরনের ভুল, যার কোনো সংশোধনী হয় না। ভুল সংশোধনীর একটা কৌতুক দিয়ে লেখা শেষ করব।
“দৈনিক সংবাদপত্রে একটি খবরের শিরোনাম ছিল ‘পুলিশের গু খেয়ে দুজনের অস্বাভাবিক মৃত্যু’। যথারীতি পাঠক মহলে হৈচৈ পড়ে গেল। পরদিন পত্রিকা ভুল সংশোধনী দিয়ে লিখল, ‘পুলিশের গুলি খেয়ে দুজনের অস্বাভাবিক মৃত্যু’ পড়তে হবে। পাঠকরা, এটা ছিল আসলে আমাদের ছাপার ভুল। এই ভুলের জন্য আমরা আন্তরিক দুঃখিত।”
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।