তনু হত্যকাণ্ড
কেরানির মেয়ের হত্যার বিচার কি সম্ভব?
নারায়গঞ্জ হত্যাকাণ্ডের দোষীদের বিচারের জন্য সরকারকে ধন্যবাদ। অনেকের ধারণা ছিল, আইনের ঘুর পথে জটিলতায় পড়ে এই হত্যাকাণ্ডর বিচার থেমে যাবে। অথবা সাক্ষীর অভাবে ছাড়াও পেয়ে যেতে পারে।
সরকারকে ধন্যবাদ যে তারা এ বিচারটা দ্রুত সম্পন্ন করতে পেরেছে। যারা দোষী সাব্যস্ত হলো তারা প্রভাবশালী এবং রাজনৈতিক যোগাযোগ সম্পন্ন। সেটা আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর নূর হোসেনই হোক অথবা আওয়ামী লীগের নেতা মোফাজ্জল হোসেন মায়ার জামাই সাঈদ তারেকই হোক। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, যারা হত্যাকাণ্ড ঘটায় তারা র্যাবের সদস্য।
তা ছাড়া র্যাব সরকারের প্রধান আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। যার মধ্যে সেনা সদস্যরাও রয়েছেন। র্যাব প্রতিষ্ঠা করে বিএনপি। ওই দলটির অনেক কিছুই অপছন্দ করলেও সরকারি দল র্যাবকে অপছন্দ করে না। কোনো ক্ষমতাবানই এদের অপছন্দ করবে বলে মনে হয় না। সাধারণ মানুষ পুলিশকে তেমনটা ভয় পায় না, কিন্তু র্যাবকে পায়।
রক্ষাকারীরাই অপরাধ করছে
নারায়নগঞ্জ মামলার গুরুত্ব হচ্ছে এখানেই, সরকার চাইলেই র্যাবেরও বিচার করা সম্ভব। বোঝা যায়, র্যাবের ভেতরেও অপরাধী আছে যারা টাকার বিনিময়ে হত্যাকাণ্ড চালাতে পারে। যাদের রক্ষা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তারা সেই ক্ষমতার বলেই অপরাধগুলো করছে। নূর হোসেন আর র্যাব এক নয়। একজন প্রতিষ্ঠিত অপরাধী, আর র্যাবকে এই অপরাধীদের ধরার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু নারায়নগঞ্জ এটাও প্রমাণ করেছে, অপরাধী আর রক্ষকের মধ্যে ব্যবধান তেমনটা পাওয়া যায় না অনেক সময়।
কিন্তু এদের বিচার করে প্রতিষ্ঠান হিসেবে র্যাব বা সরকারের ভাবমূর্তি কমেনি। অপরাধীকে যে শাস্তি পেতে হয় এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা স্বাভাবিক দুনিয়ায় বসবাস করি না। তাই আমাদের মধ্যে এতটা আশ্বর্যবোধ। এই বিচারে র্যাবের ইজ্জত যদি ক্ষুণ্ণ না হয়, সরকারের জনপ্রিয়তা যদি না কমে, তাহলে তনু হত্যার অনুসন্ধান এবং বিচার হচ্ছে না কেন?
এই সময়কার সরচেয়ে আলোচিত হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি আজও অজানা রয়ে গেছে। কলেজে পড়া একটা মেয়েকে ধর্ষণ ও হত্যার পর তাঁর লাশ পড়ে থাকল ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে অথচ, বিষয়টির সুরাহা এত দিনেও হলো না। আমরা আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের বিপক্ষে লড়াই করে এত সাফল্য অর্জন করছি কিন্তু ওই ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত অনুসন্ধান করে একটুও আগাতে পারিনি।
সরকারের জঙ্গিবাদবিরোধী সাফল্যের কথা সবাই জানে। তারা ক্রসফায়ারের মতো একটা ব্যাপারকে মানুষের মধ্যে ‘গ্রহণযোগ্য’ করে ফেলেছে শত্রুর পরিচয়ের কারণে। কিন্তু তনুর ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারছে না এটা খুব অদ্ভুত। যারা ক্ষমতার বিভিন্ন স্তর ও পরিসরে আছেন তাদেরই মধ্যে তনুর ব্যাপারে কোনো দুশ্চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। বেশির ভাগ মানুষের কাছে তনু কারো বোন, কারো কন্যা বা কারো আত্মীয়। বাঙালির সরল আবেগ আশ্রিত জীবনে তনুর পরিসরটা অনেক বড় হয়ে গেছে। সে কারণেই তনুর ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি না হওয়াটা ক্ষমতাহীন মানুষকে এতটা পীড়িত করে।
কেরানির মেয়ের বিচার
তনুর বিচার কি এ কারণেই হচ্ছে না যে তাঁর বাবা একজন কেরানি? যখন তনুর লাশ পাওয়া গিয়েছিল তখন সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তনু তাঁদেরই একজন ঘনিষ্ট মানুষ, আপনজন। কিন্তু এত দিন পরও আইএসপিআর থেকে আর কোনো বিজ্ঞপ্তি আসেনি যে তারা এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কাউকে চিহ্নিত করতে পেরেছে। তনুর বাবা-মা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের নাম পর্যন্ত বলেছিলেন কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পুলিশ একবার জানিয়েছিল, ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে অনুসন্ধান চালানোর ব্যাপারে নানা রকম জটিলতা আছে। তাই পুলিশের ক্ষমতা নেই ধর্ষক-খুনিকে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে গিয়ে পাকড়াও করার। বিষয়টির সমাধান করতে হলে ক্যান্টনমেন্টের যারা কর্ণধার তাঁদেরই ইচ্ছে প্রকাশ করতে হবে। সেটা এখন পর্যন্ত আমরা দেখিনি।
নারায়ণগঞ্জ হত্যার পরে ওই এলাকার উকিল ও রাজনীতিবিদরা প্রতিবাদে সরব হোন। এটাই স্বাভাবিক। এত বড় প্রভাবশালী গোষ্ঠী অখুশি রাখা সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। নারায়ণগঞ্জের র্যাব বাহিনী হঠাৎ করে একদিনেই খুনি হয়নি। নূর হোসেন তাদের কাছে গিয়েছিল কারণ সে জানত তারা এ কাজটা টাকার বদলে করে বা করতে পারবে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, যাদের শত্রু বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল তারা নূর হোসেনের চেয়েও বেশি প্রভাবশালী ছিলেন। কিন্তু তনুর পক্ষে যাঁরা দাড়িয়েছেন তাঁরা বিব্রতকরভাবে ক্ষমতাহীন। তাদের কথা না শুনলেও রাজনৈতিকভাবে সরকারকে কোনো দাম চুকাতে হবে না। অন্য দিকে সেনাবাহিনী হচ্ছে দেশের নিরাপত্তার সর্বোচ্চ পর্যায়। তাঁদের সম্মান রক্ষা কারর একটা বিষয় জড়িত হয়ে পড়েছে।
কিন্তু অনুসন্ধান বন্ধ রেখে ক্যান্টনমেন্টের ভাবমূর্তি কি রক্ষিত হচ্ছে? যারা একটি খুনের সুরাহা করতে পারে না তারা গোটা দেশের নিরাপত্তার দায়িত্ব কীভাবে পালন করবে, এ প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। এই মুহূর্তে এ প্রশ্নটা সরকার ও সেনাবাহিনী উভয়ের জন্য বিব্রত হওয়ার কথা, কিন্তু আমরা সেটা দেখছি না। কেউ তো বলেনি, সেনাবাহিনীর অনেকেই খুনি বা ধর্ষক। বলেছে তনুর হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে বিচার করতে। এমনও হতে পারে যে হত্যাকারী সেনাবাহিনীর কেউ নয়। কিন্তু অনুসন্ধান না করলে আমরা জানব কী করে?
তনুর হত্যাকারীকে না ধরলে এমন কোনো রাজনৈতিক দাম দিতে হবে না। কারণ তনুর বিচারের সমর্থকরা তার বাবা-মায়ের মতোই অসহায়। কিন্তু যে দেশে প্রভাবশালী এবং অসহায় দুজনই সমানভাবে বিচার পাবে তেমন একটি দেশ প্রতিষ্ঠার কথাই গোপালগঞ্জের দীর্ঘকায় একজন মানুষ স্বপ্ন দেখেছিলেন।
লেখক : সাংবাদিক ও শিক্ষক