অভিমত
কিশোররা বখে যাচ্ছে, জ্যেষ্ঠরা বখে গেছেন আগেই
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2017/01/21/photo-1485003275.jpg)
জুনায়েদের কথা মনে আছে? নুরুল্লাহ কিংবা সাদিয়া, নামগুলো কি মনে পড়ে? এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়ার কথা নয়। গত বছরের মার্চ মাসে একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল। যেখানে তরুণ জুনায়েদ আরেক তরুণ নুরুল্লাহকে বেদড়ক মারছিল। মারার এই দৃশ্য মুঠোফোনে ধারণ করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল ফেসবুক, ইউটিউবে। মনে আছে, লম্বা চুল হাত দিয়ে এদিক ওদিক করতে করতে জুনায়েদ বলছিল- ‘আমি জুনায়েদ, জুনায়েদ। কোনো মন্ত্রী-মিনিস্টার আমার কিছু করতে পারবে না।’
সে সময় এই ভিডিওটির নানা রকম বিশ্লেষণ হয়েছিল। সামাজিক রীতিনীতি নিয়ে নানা কথা হয়েছিল। সংবাদমাধ্যমগুলো নানা দিক বিবেচনা করে সংবাদ পরিবেশন করেছিল। জুনায়েদকে জেলে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল।
কোনো এক কিশোরী সাদিয়াকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট এ ঘটনায় জুনায়েদের হাতে নির্যাতিত নুরুল্লাহ যতটা না আহত হয়েছিল মার খেয়ে, তার চেয়ে বেশি আহত হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ার ওই ভাইরাল ভিডিওর কারণে।
সমাজের নানা স্তরের মানুষও কম আহত হয়নি এই ঘটনায়। আলোচনায় এসেছিল, কেন বখে যাচ্ছে তরুণসমাজ! এই অবক্ষয়ের মূল কারণ কি! কিছুদিন পর সেই আলোচনা হারিয়ে গেছে। সবাই হয়তো ব্যস্ত হয়ে পড়েছে অন্য কোনো ইস্যুতে, অন্য কোনো আলোচনায়।
সম্প্রতি প্রায় একই আলোচনা আবার সামনে হাজির। কারণ- ‘উত্তরার কিশোররা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে’। তারা ‘ভয়ংকর’ হয়েছে গ্যাং কালচারের নামে। এসব করতে গিয়ে, আধিপত্য বিস্তারের রেশ ধরে সহপাঠীদের হাতে খুন হয়েছে উত্তরার ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির।
গণমাধ্যমের বরাতে জানা গেছে, এসব কিশোর এতটাই বেপরোয়া যে আদনানকে হত্যার জন্য বের হওয়ার আগে তারা ফেসবুকে গ্রুপ ছবি পোস্ট করে যায়। ছবিতে তাদের সবাইকে নীল রঙের পোশাকে দেখা গেছে। কারো কারো হাতে ছিল হকিস্টিক। আদনানের মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পর এক কিশোর পাল্টা স্ট্যাটাস দিয়েছে, ‘ভাই তোর খুনিগো বাইর কইরা জবাই দিমু।’
অপর দিকে, উত্তরায় এই ঘটনার কয়েকদিন পর রাজধানীর তেজগাঁওয়ের তেজকুনিপাড়া এলাকায় বন্ধুদের হাতে আবদুল আজিজ নামে আরেক কিশোর খুন হয়েছে।
সিনিয়র-জুনিয়র নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে তেজকুনিপাড়া খেলাঘর মাঠে এ ঘটনা ঘটে।
এই দুটি ঘটনাই মূলত আবারও কিশোরদের বখে যাওয়ার বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে এবং এটা নিশ্চিত করে বলা যায় এই আলোচনা শেষ হবে না, বিরতিতে যাবে। আবার নতুন ঘটনা ঘটার পর শুরু হবে আলোচনা। এভাবে আবার বিরতিতে যাবে এবং ফিরে আসবে, যাবে আর আসতেই থাকবে।
কিন্তু যে বিষয়টি কখনোই আলোচনায় আসবে না বা আসে না, তা হচ্ছে বয়স্ক বা মুরুব্বিদের ‘বখে’ যাওয়ার বিষয়টি। হুম, সত্যিই প্রশ্ন তুলছি, সমাজের জেষ্ঠ নাগরিকরাও কি বখে যাননি! গেছেন, বহু আগেই গেছেন। কীভাবে।
আসুন আবার সেই ভিডিওটি নিয়ে একটু কথা বলা যাক। জুনায়েদের সেই ১০ মিনিট দৈর্ঘের ভিডিও।
জুনায়েদ যখন নুরুল্লাহকে মারছিল, তখন পাশ দিয়ে বেশ কিছু বয়স্ক মানুষ হেঁটে গেছেন। তাঁরা তাকিয়ে দেখছিলেন এবং চলে গেলেন। কিছুই বললেন না। এটা কি কোনো দায়িত্বশীল আচরণ হলো! বছর পাঁচ বা দশেক আগেও কি সমাজ এমন ছিল। সমাজের মুরুব্বিরা এমন ছিলেন। কোথাও কিশোরদের মধ্যে ঝগড়া, বিবাদ বা হাতাহাতির ঘটনায় এভাবে ঘাড় ঘুরিয়ে চলে যেতে দেখেছেন জ্যেষ্ঠদের! এখন যাঁরা জ্যেষ্ঠ তাঁরা কী ধরনের সামাজিক অনুশাসনের মধ্য দিয়ে এসেছেন!
তরুণ বা কিশোরদের মধ্যে বখে যাওয়ার এই প্রবণতা কোন সময়ে না ছিল! কিন্তু বয়স্কদের এই নির্লিপ্ততা কি আগেও ছিল! তবে কি, বয়স্কদের এই ‘বখে’ যাওয়াটাকে নিয়ে ভাবার সময় হয়নি!
গ্রামের মাঠে ঘাটে বা শহরের পাড়া-মহল্লায় কোথাও কি আর বয়স্কদের অনুশাসন খুব একটা চোখে পড়ে। পড়ে না। বয়স্করা সামাজিক বিত্তবৈভব তৈরির সংগ্রামে এতটাই ব্যস্ত যে তরুণ কিশোরদের বেড়ে ওঠা নিয়ে তাঁদের ভাবার মতো সময়ের নিশ্চয়ই তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে।
তরুণ বা কিশোরদের আধিপত্য নিয়ে অপমানজনক ভিডিও বা খুনের মতো ঘটনা যে শুধু তাদের বখে যাওয়ার কারণে ঘটে তা কিন্তু নয়। এসব ঘটনায় ভূমিকা রাখে জ্যেষ্ঠদের ব্যর্থতাও। তাই এখন সমাজেরই দায়, জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের ‘বখে’ যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী