বইমেলা
প্রজ্ঞা ও প্রতীতির মহত্তম প্রতীক
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2017/02/01/photo-1485946397.jpg)
১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় প্রথম বর্ণমালা প্রবর্তন করে সেমেটি ভাষার লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন সেকালের জ্ঞানীরা। আর ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে চীন দেশের তাং বংশের শাসনামলে সেখানকার বিখ্যাত পর্যটক সিওয়ান ডিসাং বুদ্ধদর্শন অধ্যয়নের লক্ষ্যে ভারত ভ্রমণ শেষে দেশে ফিরে ‘সামন্ত ভদ্রে’র ছবি ছাপিয়ে সর্বসাধারণের মাঝে বিলি করেছিলেন; যা প্রাচীন ছাপার সবচেয়ে পুরোনো নিদর্শন। অন্যদিকে আজ থেকে পাঁচ-ছয়শ বছর আগে জার্মানিতে জোহানেস গুটেনবার্গ সর্বপ্রথম ধাতুনির্মিত স্থানান্তরযোগ্য ২৬টি অক্ষর দিয়ে টাইপ (Movable Type) আবিষ্কার করে পশ্চিমা পৃথিবীতে মুদ্রণযন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক গোড়াপত্তন করেন। মানবসভ্যতার ইতিহাসে শুরু হলো ছাপানো বইয়ের অস্তিত্ব। আর সেই বই আজ বিশ্বব্যাপী মানুষের জ্ঞানচর্চা, বিনোদন বা সাংস্কৃতিক পরিচয় নির্ধারণের শ্রেষ্ঠতম পন্থা।
যে সাধনায় মানুষ অক্ষর বা ছাপার যন্ত্র উদ্ভাবন করেছিলেন; সেই সাধনার পরিশীলিত রূপই আজকের দিনের মানুষের মননশীলতা গড়বার কারিগর বা চিত্তবৃত্তির প্রধান অংশ। লেখকের চিন্তা-দর্শন পাঠক, ভক্ত বা অনুসারীদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যে উৎসবটি এখন সর্বব্যাপী; এক কথায় তা হলো বইমেলা। বইয়ের পসরা সাজিয়ে বই বিকিকিনির বর্ণিল আয়োজন তাই এখনকার পুরো বিশ্বেরই সাংস্কৃতিক বিপ্লব এগিয়ে নেওয়ার শ্রেষ্ঠতম উৎসব।
বাংলাদেশের বইমেলার আয়োজক আমাদের মননশীলতার প্রতীক বাংলা একাডেমি। যা অমর একুশের বইমেলা নামেই সমধিক পরিচিত। এই মেলার ব্যাপ্তি বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারিজুড়ে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি দেশের প্রকাশনা শিল্পের পথিকৃৎ চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। বিগত বছরগুলোতে এই বইমেলা নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বাংলা একাডেমির প্রান্তর ছাড়িয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত মেলার পরিসর সম্প্রসারিত করা হয়েছে। এর কারণ লেখক-প্রকাশক যেমন বেড়েছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে পাঠক বা মেলার দর্শনার্থীর সংখ্যাও বেশ বেড়েছে।
বাঙালি মনন আর বইমেলা এখন এক অবিচ্ছেদ্য নাম। আজ বিকেলে আনুষ্ঠানিকভাবে অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৭ উদ্বোধন করা হলো। এই উদ্বোধনীর মধ্য দিয়েই শুরু হয়ে গেল বাংলা একাডেমির মূল মঞ্চ থেকে বিভিন্ন সংগঠন আয়োজিত ভাষা, সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক বিষয়ের ওপর আলোচনা সভা ও অনুষ্ঠান; যা চলবে মেলার শেষ দিন পর্যন্ত। এরই মধ্যে মেলার আগেই বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে। গত বছর বইমেলায় আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অনুষ্ঠানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাহিত্যপ্রেমীরা আমাদের গ্রন্থমেলার আয়োজন দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
ভিন্ন মত ও পথের মানুষ এই বইমেলায় এসে একত্রিত হয়ে নতুন প্রকাশিত সৃজনশীল বইয়ের মনভোলানো ঘ্রাণে মুগ্ধ হন। নিজের পছন্দমতো বই কিনে নিয়ে যান। নিজে পড়েন বা প্রিয়জনকে উপহার দেন। এভাবেই মননশীলতার প্রবাহ কোটি প্রাণে ছড়িয়ে পড়ে। বইমেলা হয়ে ওঠে প্রাণের মেলা। সারবেঁধে শিশুরাসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এক কাতারে এসে বইকে ভালোবাসায় আপ্লুত হওয়ার দৃশ্য সারা বিশ্বেই অনন্য। সারা বছরের ৯০ শতাংশ বই প্রকাশিত হয় বইমেলায়। গত বছর বইমেলায় নতুন বই এসেছিল তিন হাজার ৪৪৪টি। এ ছাড়া একাডেমির নজরুল মঞ্চ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে মোট ৫৩৫টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে। এবারও দেশের চার শতাধিক প্রকাশক অন্তত চার হাজার বই প্রকাশ করবেন।
এই বইমেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। আর এটা এখন আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের রূপ পরিগ্রহ করেছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ গ্রন্থমেলার সমুদ্র থেকে জ্ঞানের মুক্তো খুঁজতে আসেন।
কিন্তু এমন একটি বইমেলাকেও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা হয়েছে। মেলার মাসখানেক আগে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সংক্রান্ত জটিলতায় শ্রাবণ প্রকাশনীকে বইমেলার স্টল বরাদ্দ নিষিদ্ধ করা হয়; আবার সমালোচনার মুখে সেই সিদ্ধান্ত বাতিলও করে বাংলা একাডেমি। গত বছর একই অভিযোগে ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তিনজনকে।
এবার আরেক ধাপ এগিয়ে মেলার আগেই পুলিশ ও একাডেমির তরফে যৌথভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে; ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে বা উন্মাদনা ছড়াতে পারে, এমন বিতর্কিত বই প্রকাশ হওয়ার আগেই তা রোধে পুলিশ ও গোয়েন্দারা কাজ করবে। তার মানে বিশেষ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে খুশি করতে লেখক বা প্রকাশককে তার বই পাঠকের হাতে দেওয়ার আগে নিরাপত্তাকর্মীদের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে। পুলিশ বলছে, যে লেখকদের এ ধরনের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অতীত রেকর্ড রয়েছে বা আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে হয়, তাঁদের বইগুলোই পড়ে দেখা হবে। অন্যদিকে প্রকাশকরা বলছেন, কারো অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে কোনো কিছুই লেখা ঠিক নয়; তবে এসবের বাছবিচারের ভার পাঠকের ওপর; পুলিশের নয়।
চুয়াল্লিশ বছর ধরেই বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ব্যক্তির স্বাধীন মত প্রকাশ নিয়ে এতদিন কোনো কথা উঠল না। যখন কিনা আমাদেরকে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সৃজনশীলতায় সামনে অগ্রসরমাণ হওয়ার কথা; সে সময় আমরা অনুভূতির পারদে জ্ঞানের পরিধি মাপছি। কিন্তু এভাবে মানুষের মুক্তবুদ্ধি আর চিন্তাকে নিরাপত্তার পেন্ডুলামে দুলিয়ে মননশীলতার চর্চা কি আদৌ সম্ভব?
বরং কথায় কথায় যাদের অনুভূতি বিনষ্ট হয় তাদেরই বোঝানোর সময় এসেছে পৃথিবীর কোনো জ্ঞান, নীতিশাস্ত্র, তত্ত্বকথা বা ধর্মাচারই সমালোচনা বা গবেষণার বাইরে নয়। মতকে বন্ধ করে না দিয়ে তার বিপরীতে বিরুদ্ধ মত প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাটাই কেবল জ্ঞানের অথৈ সাগরকে অবারিত করতে পারে। নইলে একটা জড় নির্বিকার প্রজন্মই আমরা রেখে যেতে পারব; যারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খেতে গিয়ে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে!
বইমেলা হোক বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চা ও বিনোদন পিয়াসা নিবারণের নিখাদ-নিরেট অনুষঙ্গ। মেলার পরিবেশ হোক সুস্থির। নিরাপত্তা দেওয়া হোক প্রকাশক, লেখক ও পাঠকের। কিন্তু জ্ঞানকে যেন নিষেধাজ্ঞার ঘেরাটোপে বন্দি করে ফেলা না হয়। বইমেলা আমাদের প্রজ্ঞা ও প্রতীতির মহত্তম প্রতীক। আর সেই প্রতীকের বিপ্লবকে বেগবান রাখতে হবে; এটা সব মানবিক মানুষেরই দাবি।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন