বিধানসভা নির্বাচন
ভারতে মোদি সুনামি ও দুর্নামি
গত দুই সপ্তাহের মধ্যে ভারতে আরো চারটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব রাজ্য হচ্ছে—পাঞ্জাব, উত্তরখন্ড, মনিপুর ও গোয়া। পাঞ্জাবে কংগ্রেস জিতেছে। ১১৭ বিধানসভার নির্বাচনে ৭৭টি আসন পেয়েছে তারা। আমআদমি পার্টি পেয়েছে ২০টি। পাঞ্জাবে আমআদমি পার্টির সরকার ক্ষমতাসীন ছিল। এখানে আমআদমি পার্টির ভরাডুবি ঘটেছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে থাকা বিজেপি আমআদমি পার্টির সমান সমান অবস্থানে পৌঁছেছে। তারা পেয়েছে ১৮টি আসন।
অন্যদিকে উত্তর প্রদেশের একসময়ের অংশ উত্তরখন্ডেও শাসকদল বিজেপি জয়লাভ করেছে। কংগ্রেসের অবস্থান এখানেও তলানিতে ঠেকেছে। তাদের আসনসংখ্যা ১১। গোয়াতে কংগ্রেস কোনোমতে তাদের পূর্ব অবস্থান টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। গোয়ার ৪০ আসনের বিধানসভায় কংগ্রেস ১৭টি, বিজিপি ১৩টি এবং অন্যরা ১০টি আসন পেয়েছে। অন্যদিকে, আমাদের পূর্ব দিকের ‘সপ্তকন্যার এক কন্যা’ মনিপুরে কংগ্রেস তার শাসন অব্যাহত রাখার অবস্থানে রয়েছে। এ রাজ্যে মোট আসনসংখ্যা ৬০। কংগ্রেস পেয়েছে ২৮, বিজেপি ২১ ও অন্যরা ১১। এই দুটো ছোট রাজ্যে কংগ্রেসের প্রান্তিক অবস্থানে সুযোগ নেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। গোয়াতে বিজেপি অন্যদের নিয়ে সরকার গঠনের পাঁয়তারা কষছে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব বাদ দিয়ে গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী হতে বেশ আগ্রহী। তিনি সেখানে গেলে কংগ্রেসের অবস্থান সংগতভাবেই নাজুক হয়ে উঠবে। অন্যদিকে উত্তর-পূর্ব ভারতে মনিপুরেও একই অবস্থা। এই পাহাড়ি রাজ্যে ১৫ বছরের কংগ্রেস শাসনের অবসান ঘটাতে চায় বিজেপি। সেখানে ক্ষমতাসীন দলের নেতা রাম মাধব বলেছেন, সরকার গঠনে তারা ছোট দলগুলোর সঙ্গে কথা শুরু করেছেন। তাঁর যুক্তি, সম্মিলিত ফলাফলে প্রমাণিত হয়েছে যে কংগ্রেসের ওপর রাজ্যের সাধারণ মানুষের আর ভরসা নেই। নির্বাচন-পরবর্তীকালে গোয়া ও মনিপুরে শাসন কর্তৃত্ব কার হাতে যাবে, সেটি উভয় দলের রাজনৈতিক কৌশলের ওপর নির্ভর করবে। এভাবে মোদি সরকার ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারত’ গড়তে চায়।
প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজে অনুরূপ মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। রাজধানী নয়াদিল্লিতে বিজেপির সদর দপ্তরে ১২ মার্চ নরেন্দ্র মোদি ‘এক বিজয় ভাষণ’ দেন। তিনি বলেন, ‘পাঁচ রাজ্যের এই ভোটের মধ্য দিয়ে এক নতুন ভারতের জন্ম হয়েছে। মানুষ এই নয়া ভারতকে দেখতে পাচ্ছে।...এই ভোটে কে জিতল, কারাই বা হারল, সেভাবে আমি দেখি না। আমি দেখি মানুষের আশা কীভাবে পূরণ করতে পারি।’
নির্বাচন-পরবর্তীকালে এই পাঁচ রাজ্যের জয়-পরাজয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে ভারতের গণমাধ্যমে বেশ সরস আলাপ-আলোচনা চলছে। নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতার পাটাতন শক্ত-পোক্ত হওয়ায় উল্লসিত তাঁর ভক্ত-অনুরক্তরা। ভারতের সংস্কৃতি অনুযায়ী দেবতার আসনে মোদিকে বসাচ্ছেন ভাষ্যকাররা। উত্তর প্রদেশের বিজয়কে কোনো কোনো বিশ্লেষক ‘মোদি-সুনামি’ বলছেন। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে মোদি যেভাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, এ নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি তার চেয়েও শক্তিশালীভাবে ভারতের রাজনীতিতে আবির্ভূত হলেন। তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে নেতৃত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভারতে সম্মোহনী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে ‘গান্ধী-নেহরু’র প্রভাব ছিল অভূতপূর্ব-অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এখন নরেন্দ্র মোদি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব হিসেবে গান্ধী-নেহরুর আসনকে চ্যালেঞ্জ করছেন বলে অনেকে মনে করেন। যদিও কংগ্রেস নেতা রাহুল ‘গান্ধী-নেহরু’র রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বহন করেন, এই বিধানসভা নির্বাচনের পর তাঁর নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে। স্মরণ করা যেতে পারে, রাহুল গান্ধী উত্তর প্রদেশ ও ঝাড়খন্ডে সরাসরি নির্বাচন পরিচালনা করেছিলেন। তিনি এ কথাও বলেছিলেন যে, বিহারের মতো উত্তর প্রদেশেও বুথফেরত সমীক্ষা ভুল প্রমাণিত হবে।
রাহুলের নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন মা সোনিয়া গান্ধী ও বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। যদিও পাঞ্জাবে রাহুল জয় পেয়েছেন এবং গোয়া-মনিপুরে কংগ্রেস শাসন অব্যাহত রাখার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন, তবুও ‘সব ভালো শেষ ভালো না হওয়ায় তিনি চ্যালেঞ্জের মুখেই আছেন’। উত্তর প্রদেশে রাহুলের রাজনীতি-কূটনীতি ব্যর্থ হয়েছে। এখানে রাহুল সমস্ত শক্তিকে একত্র করে রুখে দিতে চেয়েছেন মোদিকে। অখিলেশ সিংহ যাদবকে নিয়ে জোট গঠন করেছিলেন রাহুল। সেখানে তিনি যথার্থ ছাড়ও দিয়েছিলেন সমাজবাদী পার্টিকে। জোট জিতলে অখিলেশ মুখ্যমন্ত্রী হবেন—এই আশ্বাসও দিয়েছিলেন। কিন্তু মোদি কৌশলের কাছে তাঁর সম্মিলিত ঐক্যের দাবি ব্যর্থ হয়। রাজনৈতিক ভাষ্যকার গণবিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদির উত্তর প্রদেশ তথা উত্তর ভারত বা ‘আর্যাবর্ত’ জয়ের কারণ হিসেবে যেসব বিষয় উল্লেখ করছেন তা এ রকম—ক. বিজেপিপ্রধান অমিত শাহের সব বর্ণের সম্মিলিত ঐক্য। হিন্দুধর্মের সনাতন প্রথা অনুযায়ী বিভক্ত সব গোষ্ঠীকে একত্র করতে সক্ষম হন তিনি। সেখানে তাদের অনুসৃত ‘হিন্দুদভা’ আদর্শ হিসেবে অনুসৃত হয়। এদের সম্মিলিত জোটে একজন মুসলমানকেও প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। যদিও উত্তর প্রদেশে বিপুলসংখ্যক মুসলমান রয়েছেন। তাঁরা সংখ্যালঘিষ্ঠ হলেও দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। অন্যদিকে কংগ্রেস সমাজবাদী দলের জোট প্রায় ১০০ মুসলমানকে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করায়। এভাবে অবশেষে নির্বাচনী যুদ্ধটি যাদব-মুসলিম বনাম অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র বিভেদ ছড়ায়।
খ. শত্রুর শত্রুমিত্র—এই নীতি অবলম্বন করে অমিত শাহ বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) নেতা সামি প্রসাদ মৌর্যকে বিজিপিতে অন্যতম নেতার আসনে বসিয়ে দেন। বিএসপি ও মুসলিম ঐক্যজোট উত্তর প্রদেশে দীর্ঘকাল ধরে নির্বাচনে নির্ধারকের ভূমিকা পালন করে আসছে। বিজেপি, কংগ্রেস এবং অখিলেশ বিরোধীদের ধর্মীয় বিভাজন ব্যবহার করে তাদের বিজেপি জোটে কাজে লাগায়। বিজেপিপ্রধান এই নির্বাচনকে সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলিম এবং যাদব সম্প্রদায়ের প্রাধান্যের বিরুদ্ধে উঁচু বর্ণের হিন্দু তথা সবার ‘ইজ্জতের ছওয়াল’ বলে প্রমাণ করতে সক্ষম হন। এই কৌশল অবলম্বন করে অমিত শাহ প্রায় ১৫০ বিধানসভা নির্বাচনে ‘অযাদবদে’র মনোনয়ন দেন।
গ. বিজেপি উপ-আঞ্চলিক প্রবণতাকেও ব্যবহার করে। যেমন—তারা ‘আপনা দল’, ‘সোহেল দেব’, ভারতীয় সমাজপার্টির মাধ্যমে প্যাটেল, কুমিজ ও রাজভরের মতো নিম্ন সম্প্রদায়কে তাদের পক্ষে একত্র করে। ঘ. বিজেপি সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মধ্যে ভেদ-বুদ্ধি সৃষ্টি করে। নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনকে ‘কবরস্থান এবং শ্মশানের দ্বন্দ্ব’ বলে অবহিত করেন। অমিত শাহ প্রতিপক্ষকে আমির আজমাল কাসাবের লোক বলে দোষারোপ করেন। কাসাব সেই পাকিস্তানি, যে ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে হামলা পরিচালনা করেছে বলে ভারত অভিযোগ করে।
ঙ. বিজেপির নির্বাচন পরিচালনা করতে গিয়ে তৃণমূল পর্যায়ের নেতৃত্বকে গুরুত্বপূর্ণভাবে উপস্থাপন করে। চ. বিজেপি এ নির্বাচনে জয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সুনাম-সুখ্যাতি ও ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে। আমাদের দেশেও উপনির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধী নেত্রী প্রচারণায় অংশ নেন না। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিধানসভার এই নির্বাচনে সর্বোচ্চ প্রভাব বিস্তার করেন। তিনি সেখানে ১০টির পরিবর্তে ৩০টি জনসভা করেন। সেখানে রাতযাপন করেন এবং দিকনির্দেশনা দেন। উল্লেখ্য, তা নির্বাচনী এলাকা বেনারস উত্তর প্রদেশেই অবস্থিত। ২০১৪ সালে যখন তিনি এই এলাকা থেকে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেন, তখনো তিনি এত পরিশ্রম, সময় ও শ্রম ব্যয় করেননি। ছ. বিজেপি অন্য দল থেকে যোগ্যতম প্রার্থীদের ভাগিয়ে নিয়ে এসে নিজ দল থেকে মনোনয়ন দান করেন। একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী কমপক্ষে ১০০ আসনে তারা এ কাজটি করে। নিজ প্রার্থীদের পরিবর্তে জয়লাভের সম্ভাবনা আছে এ রকম ভিন্ন প্রার্থীদের তারা অগ্রাধিকার প্রদান করে।
এই পাঁচ প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন ছিল নরেন্দ্র মোদির কথিত বিপুল জনপ্রিয়তার একটি বড় পরীক্ষা। আর তিনি এ পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তিনি যখন কালো টাকার দাপট মোকাবিলা করার জন্য ভারতীয় মুদ্রা অচল ঘোষণা করেন, তখন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভাষ্যকারদের আশঙ্কা ছিল যে তিনি এ কাজের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা হারাবেন। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাবলি প্রমাণ করে যে এর ফলে তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়েছে বৈ কমেনি। বিরোধী দল বিষয়টিকে নেতিবাচকভাবে ব্যাখ্যা করে। তারা বলছিল, এতে দেশে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, জনগণের জন্য ভোগান্তির সৃষ্টি করবে এবং বিজেপির জন্য জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণ হবে। কিন্তু তাদের কোনো আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হয়নি। বিরোধীদের এই আশঙ্কা শুধু উত্তর প্রদেশের ক্ষেত্রেই অবাস্তব প্রমাণিত হয়নি; বরং মুদ্রা অচলের পর অনুষ্ঠিত ছত্তিশগড়, গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও উড়িষ্যার বিভিন্ন নির্বাচনে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এসব নির্বাচনে বিজেপি স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাপকভাবে জয়লাভ করে। এটি ভারতীয় গণতন্ত্রের বিজয়।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।