গণভোট
এবার তুরস্ক কেমন হবে?
এই লেখা যখন লিখছি, তখন তুরস্কের প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বৃদ্ধি ও সংবিধান সংশোধনের ওপরে গণভোটের ফল ঘোষণা করা হয়েছে। এতে এই গণভোটের বিল আনয়নকারী প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইয়িলদিরিমের ক্ষমতাসীন একেপি ও ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী দল এমএইচপির সমর্থিত ‘হ্যাঁ’-এর পক্ষে ভোট পড়েছে প্রায় ৫১.৩ শতাংশ এবং অন্যদিকে সংবিধান সংশোধনের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া কামাল আতার্তুকের দল হিসেবে পরিচিত সিএইচপি, কুর্দিশ প্রভাবিত রাজনৈতিক দল এইচডিপি সমর্থিত ‘না’-এর পক্ষে ভোট পড়েছে প্রায় ৪৮.৫ শতাংশ। এই গণভোট অনুষ্ঠিত হলো এমন এক সময়ে, যখন তুরস্ক গত বছরের ১৫ জুলাইয়ের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুথানের পর বিভিন্নভাবে একটি অস্থিতিশীল সময় পার করছে। এই গণভোটের ফলে তুরস্কের সাবেক সামরিক বাহিনী কর্তৃক রচিত সংবিধানে অনেকগুলো পরিবর্তন আনার মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে।
তুরস্কের ‘ভবিষ্যৎ নির্ধারণী’ এই গণভোটের ফলে সংবিধানের সংশোধনী অনুসারে মূলত সর্বমোট ১৮টি পরিবর্তন আসবে। গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মাঝে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আদলে তুরস্ক-রীতির প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির প্রবর্তন, যাতে বর্তমান সংসদনির্ভর পদ্ধতির বিলুপ্তি ঘটবে ও সংসদের ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস করা হবে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে এরদোয়ান নির্বাহী ক্ষমতার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পাবেন এবং তিনি একই সঙ্গে তাঁর দলের দায়িত্ব নিতে পারবেন। ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত করা হবে এবং ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ সৃষ্টি করা হবে। মন্ত্রিপরিষদ সংসদের বদলে প্রেসিডেন্টের কাছে জবাবদিহি করবে এবং তিনি মন্ত্রিপরিষদের নিয়োগের পূর্ণ ক্ষমতা রাখবেন। স্থায়ী দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুবিধার্থে সরকারের মেয়াদ ও নির্বাচন হবে বর্তমানে প্রতি চার বছরের বদলে প্রতি পাঁচ বছর পরপর এবং এরদোয়ান এর মাধ্যমে আরো দুবার নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। সংসদের আইন প্রণয়ন ক্ষমতা স্বাভাবিক থাকবে এবং সংসদের সদস্য সংখ্যা ছয়শ’তে উন্নীত করা হবে।
যুবক, যুবশক্তি, যুব নেতৃত্বকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের সুযোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে সংসদ সদস্য হওয়ার বয়স ২৫ থেকে ১৮-তে নির্ধারণ করা হবে। সংসদের ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে সংসদ প্রেসিডেন্টের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনয়ন ও বিচারের মুখোমুখি করতে পারবে। সংসদের সমর্থন সাপেক্ষে প্রেসিডেন্ট জরুরি অবস্থা ঘোষণা, বৃদ্ধি ও প্রত্যাহার করতে পারবেন। প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশ জারির ক্ষমতা থাকবে এবং এটি সংসদের কোনো আইনের বিপক্ষে গেলে এর কার্যকারিতা রহিত হবে। বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করা হবে।
গণভোটে বিজয়ের ফলে তাৎক্ষণিকভাবে আগামী ৩০ দিনের মধ্যে সেনা অফিসারদের হাতে তৈরি প্রচুর বিতর্ক সৃষ্টিকারী তুরস্কের বিচারক ও তদন্তকারী নিয়োগ সংস্থার পুনর্বিন্যাস করা হবে। এর সঙ্গে যুদ্ধাবস্থা ব্যতীত সামরিক সব আদালত বিলুপ্ত করা হবে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির ওপর এরদোয়ানের নিয়ন্ত্রণ আরো উন্নত হবে এবং এর অন্তত পাঁচজন সদস্য তিনি নিজে বাছাই করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে সামনের দিনে সিরিয়া কিংবা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে তুরস্কের ক্ষমতা প্রদর্শনের মতো বিষয়ে এরদোয়ান তাঁর অভিব্যক্তি বাস্তবায়ন করতে পারবেন। এর ফলে তাঁর প্রস্তাবিত ২০২৩ সালের মাঝে তুরস্ককে মধ্যপ্রাচ্যে ও ইউরোপের মাঝে একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন, সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন আরো অধিকতর সহজ হবে।
এরদোয়ানের বিরোধীরা বিভিন্নভাবে এসব সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলেও জনগণের এই স্মরণীয় রায়ের ফলে বাস্তবে এতে তুরস্কের বর্তমান দুর্বল শাসনব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে বলে আশা করা যায়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের তিন বিভাগের মাঝে সমন্বয় প্রতিষ্ঠিত হবে এবং একমুখী শাসনব্যবস্থায় একটি শক্তিশালী সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। সামরিক বাহিনী কর্তৃক রচিত সংবিধানের পরিবর্তনের মাধ্যমে সম্ভবত তিনি জনগণের ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দিতে চেয়েছেন। তাঁর প্রতিপক্ষরা একে তাঁর ক্ষমতা গ্রাসের উপকরণ বলে দাবি করলেও তুরস্কের জনগণ তাঁদের ভোটাধিকারের মাধ্যমে এরদোয়ানের ওপর আস্থা রেখে অবশ্য তাঁদের এ দাবিকে নাকচ করে দিয়েছে।
লেখক : তুরস্কে অধ্যয়নরত