প্রধানমন্ত্রীর ভুটান সফর
কী পেল বাংলাদেশ?
ভারত সফর শেষ হতে না হতেই ভুটানে আরেকটি ফলপ্রসূ সফর শেষ করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূলত পারস্পরিক সহযোগিতার নতুন পথ খুঁজতে প্রধানমন্ত্রীর এই সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ সফরে বিশেষ দিক ছিল আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মা ও মেয়ের নেতৃত্ব প্রদানের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের অংশ হিসেবে ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে অনুষ্ঠিত অটিজম ও নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার (এনডিডি) সংক্রান্ত উচ্চ পর্যায়ের এক আলোচনা সভায় অংশ নেন। মূলত সায়মা ওয়াজেদের সঞ্চালনায় এ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভাপতিত্ব করেন।
ভুটানে প্রধানমন্ত্রী নানাভাবে সংবর্ধিত হন। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সারা বিশ্বে অটিজম সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিতে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করেন অন্য অতিথিবৃন্দ। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী অটিজম সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিতে সায়মা ওয়াজেদের ভূমিকারও প্রশংসা করেন। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে অটিজম বিষয়ে সায়মা ওয়াজেদ হু’র চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় তাঁকে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী অভিনন্দন জানান। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং ভুটানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে এবং সূচনা ফাউন্ডেশন, অ্যাবিলিটি ভুটান সোসাইটি (এবিএস), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব আঞ্চলিক অফিসের টেকনিক্যাল সহায়তায় তিন দিনব্যাপী এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে অটিজম উন্নয়ন বিষয়ে একটি রোডম্যাপ পাওয়া যায়।
বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার বর্তমান প্রেক্ষাপটে এককভাবে কোনো দেশের পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বিশেষ করে স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পরও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের কার্যকর সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। উন্নয়নের সোপানে পা রাখতে গিয়ে সম্পর্কের এই ঘাটতি উপলব্ধি করতে পেরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করতে নানা রকম উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে চলেছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এখন অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভালো। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে গড়ে ওঠা উপ-আঞ্চলিক জোট বিবিআইএনের মধ্যে কানেক্টিভিটি বাড়ানোসহ অনেক বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। থাইল্যান্ড, মিয়ানমারসহ বঙ্গোপসাগরভিত্তিক জোট বিমসটেকের মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্র বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীনের সঙ্গেও কানেক্টিভিটি সম্প্রসারণের কাজ এগিয়ে চলেছে।
প্রধানমন্ত্রীর ভুটান সফরের সঙ্গে বাংলাদেশের মোট ছয়টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নৌ-প্রটোকল রুট ব্যবহারসংক্রান্ত এমওইউ। এই চুক্তির আওতায় ভুটান বাংলাদেশের বন্দর ও নদী ব্যবহারের সুযোগ পাবে। বন্দর সুবিধা না থাকা দেশটির আমদানি-রপ্তানির জন্য এটি অত্যন্ত সাশ্রয়ী হবে। এর ফলে বাংলাদেশ যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হবে, তেমনি এ ক্ষেত্রে বহু বাংলাদেশির কর্মসংস্থানও হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের স্থায়ী দূতাবাস নির্মাণের জন্য ভুটান বাংলাদেশকে জমি দিয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী তাতে দূতাবাস ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। ভুটানে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের যে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে, ত্রিদেশীয় যৌথ উদ্যোগে সেই সম্ভাবনা কাজে লাগানোর বিষয়ে আলোচনায়ও যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। আঞ্চলিক যোগাযোগ ও সহযোগিতা বৃদ্ধির অন্যান্য ক্ষেত্র নিয়েও দুই দেশের মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরে যোগাযোগের সুবিধা কাজে লাগিয়ে ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক সম্প্রসারণের লক্ষ্যে মূলত কয়েকটি চুক্তি হয়েছে বাংলাদেশের। একাত্তরে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদাতা দেশ হিসেবে ভুটানের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। সেই সম্পর্ককে আরো জোরদার করতে প্রধানমন্ত্রীর এ সফর যথেষ্ট প্রশংসিত হয়েছে। ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়েও প্রধানমন্ত্রী ভুটানের সমর্থন চেয়েছেন। ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জলবিদ্যুতে সহযোগিতা নিয়েও আলোচনা হয়েছে শেখ হাসিনার। বাংলাদেশি ডাক্তারদের থিম্পুতে সরকারিভাবে চাকরির বিষয়ও দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায় উঠে আসে।
পারস্পরিক স্বার্থে কানেক্টিভিটিসহ নানা মাত্রিক উন্নয়ন সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভুটানের বিশেষ সম্পর্ক গড়ার প্রয়োজন অনুভব করেই প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে নানা ইতিবাচক দিক ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে মোংলা বা পায়রা বন্দর থেকে নদীপথে লালমনিরহাট পর্যন্ত পণ্য পরিবহন করা গেলে ভুটানের আমদানি-রপ্তানির পণ্য পরিবহন খরচ অনেক কমে যাবে। সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি ও সমঝোতার মধ্যে সিরাজগঞ্জ থেকে তিস্তা ব্যারাজের কাছাকাছি দইখোয়া পর্যন্ত ও আশুগঞ্জ থেকে ফেঞ্চুগঞ্জ পর্যন্ত নদী খননের চুক্তি হয়েছে। কাজটি যত দ্রুত সম্পন্ন করা যাবে, ভুটান ও নেপালের পক্ষে বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সম্ভাবনা তত বাড়বে। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর পণ্য পরিবহনও সহজতর হবে। অন্যদিকে দুটি নদী খনন করা গেলে বন্যার প্রকোপও অনেক কমে যাবে।
আমরা আশা করি, ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের যে নবযাত্রা সূচিত হয়েছে, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো জোরদার হবে। সবশেষে এ কথা বলা যায় যে পারস্পরিক ইতিবাচক সহযোগিতার মাধ্যমে দুই দেশের সমৃদ্ধির জন্য প্রধানমন্ত্রীর এই সফর যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।