অভিমত
ফ্রান্সের নির্বাচনী গণতন্ত্রের সমীকরণ
প্রথম দফায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শেষে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এগিয়ে আছেন ইমানুয়েল ম্যাকরোঁ ও ম্যারি লি পেন। আগামী ৭ মে দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে আবারো মুখোমুখি হবেন তাঁরা। নির্বাচনের প্রথম ধাপে ইমানুয়েল ম্যাকরোঁ ২৩.৮০ শতাংশ ও ম্যারি লি পেন ২১.০৬ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। যদি কোনো প্রার্থী নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট না পান, তাহলে দুই সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয় দফায় ভোট হয়। ১৯৬৫ সাল থেকে ফ্রান্সের প্রতিটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনই দ্বিতীয় দফার ভোটে নিষ্পত্তি হয়েছে। দেশটিতে এবারের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য লড়াই করেন ১১ জন প্রার্থী। কেউ ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পাওয়ায় সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দুই প্রার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় দফার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
দেশটিতে গত কয়েক বছরে একের পর এক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা এবারের নির্বাচনে একটা বড় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। ফ্রান্সে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে এ পর্যন্ত ২৩০ জনের বেশি মানুষ সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছে। ২০১৫ সালে প্যারিস হামলার পর দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। এখনো তা বলবৎ রয়েছে। বর্তমানের ফ্রান্সে রাজনীতিতে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, মূলত প্রচলিত রাজনীতির দিন শেষ। মধ্যপন্থী ইমানুয়েল ম্যাকরোঁ এবং উগ্র দক্ষিণপন্থি মারিন লি পেন প্রচলিত রাজনীতিকে বাজিমাত করে দিয়েছেন। এখন দ্বিতীয় দফার অপেক্ষায়। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোতে যখন অনিশ্চয়তা, ব্যক্তিত্বের সংকট চলছে, তখন অর্থনৈতিক স্থবিরতা, অনিয়ম, কেলেঙ্কারির অভিযোগ, বেকারত্বের হার বৃদ্ধি এবং বারবার সন্ত্রাসী হামলার মুখে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন, তখনই সামনে চলে আসেন এই দুই প্রেসিডেন্ট প্রতিদ্বিন্দ্বী ম্যাকরোঁ ও লি পেন।
আগামী ৭ তারিখের দ্বিতীয় দফা নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে নানা সমীকরণ। কট্টর-ডানপন্থী দল ন্যাশনাল ফ্রন্টের (এফএন) নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দলটির প্রার্থী লি পেন। তিনি মূলত দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে রেখে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে চাচ্ছেন। অন্যদিকে জনমত জরিপে স্পষ্টভাবে দ্বিতীয় পর্বের ভোটেও ম্যাকরোঁ ফেভারিট। তারপরও জয়ের ব্যাপারে লি পেনের প্রত্যয় যথেষ্ঠ। আর সেদিক থেকেই চলছে উভয় প্রার্থীর ভোটের পাল্লা ভারি করার সব প্রচেষ্টা। প্রথম দফায় নির্বাচন থেকে বাদ পড়া সোশ্যালিস্ট ও রিপাবলিক দলের দুই প্রার্থী বেনিউট হামন ও ফ্রাঁসোয়া ফিলোঁ ইতিমধ্যেই কট্টরবাদী ম্যারি লি পেনকে ঠেকাতে ইমানুয়েল ম্যাকরোঁকেই সমর্থন জানিয়েছেন। তবে বাম দলের প্রার্থী জ্যঁ-লুক মিলনশঁ দ্বিতীয় পর্বে কাকে সমর্থন করবেন, তা বলেননি। আদর্শগতভাবে ভিন্নমতাবলম্বী হলেও তাঁরা উভয়ই ইউরোপীয় ইউনিয়নবিরোধী।
এই নির্বাচনের বড় প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বিশ্ব রাজনীতিতে। মূলত এই নির্বাচনের ফলাফল বদলে দিতে পারে ফ্রান্স আর ইউরোপের রাজনীতির ভবিষ্যৎ। সেই সঙ্গে বিশ্বে উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থানে ফ্রান্স সামিল হওয়ার সিদ্ধান্তটিও নির্ধারিত হয়ে যাবে। ভোটের ব্যবধান কম হলেও, ম্যাকরোঁর এই জয়লাভ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধারণা করা হচ্ছে, লি পেন বিজয়ী হলে ফ্রান্সের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ যে চূড়ান্ত ভোটাভুটির পূর্বেই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠত। ব্রেক্সিট ও ট্রাম্পের জয়লাভের পর থেকে, ইউরোপ উগ্র জাতীয়তাবাদী বিদ্বেষীদের কব্জায় যাওয়ার আশঙ্কা উদারপন্থীদের ছড়িয়েছে। অভিবাসন নীতিতে কট্টর ডানপন্থী নেতা লি পেন কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তিনি অভিবাসী অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্ত বন্ধ করে দেবেন বলে জানিয়েছেন। তার অভিবাসন নীতিকে সমর্থন জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সম্প্রতি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ফ্রান্সের সব মসজিদ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন লি পেন।
ফ্রান্সের এই নির্বাচনের আরেকটি বিশেষ দিক লক্ষণীয় হলো, নির্বাচনে প্রধান দুটি দল বড় ধরনের বিপর্যয়ে পড়েছে। গত ছয় দশকের মধ্যে এমন ঘটনা প্রথমবার। মূলধারার দলগুলো যে ফরাসিদের ভাবনায় শামিল হতে পারছে না তা ভোটের ফলাফলই প্রমাণ করছে। লি পেন ফ্রান্সের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিজয়ী হলে ফ্রান্সের সঙ্গে ইউরোপের রাজনীতির ভবিষ্যৎ সংকটের মুখে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ লি পেন ভোটের কয়েক দিন আগে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মৃত্যু ঘটবে। ইইউ থেকে বেরিয়ে আসার পাশাপাশি ইইউর অভিন্ন মুদ্রা ইউরো বাতিল করবেন বলেও তিনি ঘোষণা দিয়েছেন। অভিবাসন নীতিতে কট্টর ডানপন্থী নেতা লি পেন কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তিনি অভিবাসী অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্ত বন্ধ করে দেবেন বলে জানিয়েছেন। তার অভিবাসন নীতিকে সমর্থন জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সম্প্রতি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ফ্রান্সের সব মসজিদ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন লি পেন।
অন্যদিকে মধ্যপন্থী ইমানুয়েল ম্যাকরোঁ ফ্রান্সের উদারপন্থীদের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তিনি বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোঁয়া ওলাঁদের উপদেষ্টা এবং পরে তাঁর সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। ২০১৬ সালে তিনি সরকারের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে নিজের মধ্যপন্থী সংগঠন ‘অন দ্য মুভ’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে এবং নিজেকে তিনি বাম কিংবা ডান বলতে নারাজ। ম্যাকরোঁ প্রেসিডেন্ট হিসেবে জয় লাভ করলে তিনি ফ্রান্সের ইতিহাসের সবচেয়ে কম বয়সী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে ফ্রান্সের বেকারত্ব ইস্যু। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ গুলোর মধ্যে ফ্রান্সে বেকারত্বের হারে ৮ম অবস্থানে আছে। ফ্রান্সে বর্তমান বেকারত্বের হার প্রায় ১০%।
আমেরিকায় রক্ষণশীল ট্রাম্পের বিজয়, ব্রিটিশদের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগে নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্সসহ আরো কিছু ইউরোপীয় দেশে কট্টর জাতীয়তাবাদীদের মাঝে বিপুল উচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল। প্রথমে নেদারল্যান্ডসে তাঁদের পারজয় হলো। সম্ভবত, ফ্রান্সেও তাঁদের একই ভাগ্য বরণ করতে হবে। এতে কট্টরপন্থীদের উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়বে বলেই মনে হয়। তাই ফ্রান্সের প্রথম পর্বের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ফ্রান্সের তথা ইউরোপীয় গণতন্ত্রেরই বিজয় বলে মনে হচ্ছে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।