অভিমত
সনদনির্ভর শিক্ষায় হাহাকারের চিত্র
গত ৪ মে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে, একটি বোর্ডে পাসের হারে ধস নামায় মূলত পুরো পরীক্ষার ফলের চাকচিক্য মলিন হয়ে গেছে। বিজ্ঞান বিভাগ ছাড়া অন্যান্য শাখায় জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও এবার কমেছে। একটি জাতীয় দৈনিক ফল খারাপের পেছনে দুটি কারণ রয়েছে বলে জানিয়েছে। প্রথমত, এবার নতুন পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয়েছে, যাতে পরীক্ষার্থীরা আগের মতো ‘ঢালাও’ নম্বর পায়নি। দ্বিতীয়ত, কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার গতবারের চেয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ কমে যাওয়ায় সার্বিক গড় পাসের হার কমেছে।
এবার কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার ৫৯ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। গতবার পাসের হার ছিল ৮৪ শতাংশ। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুল খালেকের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি জানায়, মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২৫ হাজার ৬০৬ জন ইংরেজিতে অকৃতকার্য হয়েছে এবং গণিতে অকৃতকার্য হয়েছে ৩৪ হাজার ৯৮৯ জন। তাঁর ভাষ্যমতে, মূলত মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষার্থীরা খারাপ করেছে।
এখানে কয়েকটি বিষয় উঠে এসেছে। দেখা যাচ্ছে, নতুন পদ্ধতিতে মূল্যায়নের প্রভাবে শিক্ষার্থীদের ফল খারাপ হয়েছে। আমাদের প্রশ্ন হলো, একটি নতুন পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হলো অথচ শিক্ষার্থীরা আগেভাগে সেটি জানতে পারল না কেন, ঠিক কোন উপায়ে তাদের উত্তরপত্রে নম্বর দেওয়া হবে। অথবা কেনই বা শিক্ষকরা তাদের সে বিষয়গুলো বুঝিয়ে দিতে পারলেন না। নাকি শিক্ষকদের পরীক্ষা অনুষ্ঠানের পরে নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে ব্রিফ দেওয়া হয়েছে?
অন্যদিকে ‘ঢালাওভাবে’ নম্বর প্রদানের কথা বলা হচ্ছে। দৈনিক প্রথম আলো তাদের অনুসন্ধানে বলেছে, এবার শিক্ষার্থীরা ‘ঢালাও’ নম্বর পায়নি বলে ফলের চিত্র এমন হয়েছে। সত্যিই যদি এমনটি ঘটে থাকে, তাহলে তো অভিভাবকরা প্রশ্ন তুলতেই পারেন, বিগত বছরগুলোতে কেন শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্রে ‘ঢালাও নম্বর’ দেওয়া হলো? এই ‘ঢালাও নম্বরে’ হয়তো পাসের হার ও জিপিএ ৫-এর সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হয়নি তো?
কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে এবার শুধু গণিতেই অকৃতকার্য হয়েছে ৩৪ হাজার ৯৮৯ শিক্ষার্থী। আমরা বরাবরই সরকারকে বলে আসছি, গণিত-ভীতি কাটানোর উদ্যোগ নিন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মাধ্যমিক পর্যায়েই এই ভীতি প্রকট থাকে। গণিত বোঝার পদ্ধতি সহজ করা ও গণিত অলিম্পিয়াডসহ নানা ধরনের কর্মসূচি মফস্বল থেকে শহর পর্যন্ত বিস্তৃত করে গণিতের সঙ্গে যেন শিক্ষার্থীদের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, সে ব্যবস্থা করতে হবে এখনই।
পত্রিকার সূত্র অনুযায়ী, ১০টি শিক্ষা বোর্ডের এবারের গড় পাসের হার ৮০ দশমিক ৩৫ শতাংশ, যা গতবারের চেয়ে ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ কম। এবার ১০ বোর্ডে জিপিএ ৫ পেয়েছে এক লাখ চার হাজার ৭৬১, যা গতবারের চেয়ে পাঁচ হাজার কম। মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ছাড়া আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন এসএসসিতে পাসের হার গতবারের চেয়ে ৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ কমেছে। এই আট বোর্ডে এবার পাসের হার ৮১ দশমিক ২১ শতাংশ।
জিপিএ ৫ এবং পাস-ফেলের বিষয়টি সনদনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সনদনির্ভর শিক্ষায় শিক্ষার্থী কী শিখল, না শিখল তার চেয়েও গুরুত্ব দেওয়া হয় তার সনদের চেহারা কত সুন্দর। এ জন্য শিক্ষার্থী-অভিভাবক থেকে শুরু করে বিদ্যালয়ের স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নজর থাকে শুধু ভালো নম্বর অর্জনের দিকে। এবং কোনো শিক্ষার্থী যদি এই কথিত ভালো ফল অর্জনে কোনো কারণে ব্যর্থ হয়, সে ক্ষেত্রে তার ব্যর্থতার শেষ থাকে না এবং এই গ্লানি তাকে জীবনভর বয়েও বেড়াতে হয় অনেক ক্ষেত্রে। কারণ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের বিভিন্ন পর্যায়েও পূর্বে অর্জিত সনদকেই মূল্যায়ন করা হয়, যদিও ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো কলেজে ভর্তি হতে মাধ্যমিকের ভালো ফল গুরুত্বপূর্ণ, আবার ভালো ফল না থাকলে তো অনেক নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রাথমিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণও করা যায় না।
পাবলিক পরীক্ষায় সনদ-নির্ভরতা যে আমাদের জাতীয় জীবনের গ্লানিকে বাড়িয়ে দিয়েছে, তার একটি বড় প্রমাণ হলো পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত পাঁচজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা। কে তাদের শেখাল যে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলেই ট্রেনের নিচে নিজেকে সঁপে দিতে হয়, গলায় দড়ি দিতে হয় কিংবা বিষপান করতে হয়! কে তাদের বলল যে, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে সমাজে আর মুখ দেখানোর মতো উপায় থাকে না! দৈনিক মানবজমিন, এনটিভি অনলাইন ও বাংলা ট্রিবিউন জামালপুর, চট্টগ্রাম, পিরোজপুর, যাত্রাবাড়ী ও শরীয়তপুরে পাঁচ শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে আত্মহত্যার খবর দিয়েছে।
আমরা এর আগেও বলেছি যে, শিক্ষার একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকতে হয়, নয়তো সে শিক্ষা নিয়ে বেশিদূর অগগ্রসর হওয়া কঠিন, ঘনঘন সিলেবাস ও মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তন, পাসের ও জিপিএ ৫-এর হার বৃদ্ধির তাগিদ দেখে মনে হয় যেন স্বয়ং আমাদের শিক্ষা কর্তৃপক্ষ এসব বিষয় নিয়ে বিচলিত। এখনই সময় নিজেদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে স্থিতিশীলতা নিয়ে আসতে হবে, নয়তো সমাজ ও শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।
লেখক : অধ্যাপক ও সভাপতি, গণিত বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।