ব্রিটিশ নির্বাচন
কে হারে, কে জেতে?

গণতন্ত্রের দোলনা (Cradle of Democracy) বলে কথিত ব্রিটেনে আসন্ন সাধারণ নির্বাচন নিয়ে দোদুল্যমানতার সৃষ্টি হয়েছে। ২০১১ সালের জাতীয় নির্বাচন বিধি অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা ২০২০ সালের মে মাস নাগাদ। কিন্তু ব্রেক্সিট, অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে ব্রিটিশ রাজনীতিতে রীতিমতো তোলপাড় ঘটে। ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল দলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনকে পদত্যাগ করতে হয়। তিনি ব্রেক্সিটবিরোধী ছিলেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে টেরিজা মে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইচ্ছা করলে তিনি ২০২০ সাল অবধি নির্বিঘ্নে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারতেন। কিন্তু ব্রিটিশ গণতন্ত্রের ইতিহাস-ঐতিহ্য অনুযায়ী তিনি জনগণের আস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন। বড় ধরনের জাতীয় সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর এ পদক্ষেপ ছিল যৌক্তিক এবং গণতান্ত্রিক। এ বিষয় তিনি হাউস অব কমন্স তথা প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্বশীল নিম্নকক্ষে মতামত যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নেন।
গত ১৯ এপ্রিল নিম্নপরিষদ ৫২২ ভোটের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মাত্র ১৩ ভোট বিপক্ষে যায়। এ ধরনের নির্বাচনকে আমরা ‘মধ্যবর্তী’ নির্বাচন বলতে পারি। প্রবীণ রাজনীতিবীদ টেরিজা মে এই মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে তাঁর নড়বড়ে কোয়ালিশন সরকারকে শক্ত ভিত্তি দিতে চেয়েছিলেন হয়তো। উল্লেখ্য, রক্ষণশীল দল ২০১০ সাল থেকে ক্ষমতায় রয়েছে। ২০১৫ সালের নির্বাচনে তারা সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ হয়। সে কারণে রক্ষণশীলরা স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং নর্দার্ন আইরিশ ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে বাধ্য হয়। ভেঙে দেওয়া সংসদে প্রধান বিরোধীদল লেবার পার্টি বা শ্রমিকদলের বিপরীতে মাত্র ১২ জনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা তাঁরা দেশ পরিচালনা করছিলেন। যেহেতু ব্রেক্সিটের মতো জনপ্রিয় ইস্যুতে টেরিজা মে-র বড় ভূমিকা ছিল, সেহেতু তিনি আশা করছিলেন নতুন নির্বচনের মাধ্যমে তাঁর পরনির্ভরশীলতা ঘুচবে। তিনি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আবার সরকার গঠন করলেন। তাঁর এ আশাবাদের বাস্তবতাও ছিল।
আশা করা যাচ্ছিল, ব্রেক্সিটের বিষয়টি নির্বাচনে প্রাধান্য পাবে। ব্রিটিশ জনগণের স্বকীয় মর্যাদার মনস্তত্ত্বকে ব্যবহার করে উতরে যাবেন টেরিজা মে। এর সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে অর্থনীতি, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের মতো বিষয়াদি। জনমত যাচাই করে নির্বাচনের পূর্বাভাস প্রদানে ব্যস্ত সংগঠনগুলো টেরিজা মে-র রক্ষণশীল দলের পক্ষে প্রতিবেদন প্রকাশ করছিল। কিন্তু হঠাৎ করে লন্ডন ও ম্যানচেস্টার ম্যাসাকার সব হিসাব-নিকাশকে পাল্টে দিতে শুরু করে। আজ ৪ জুন লন্ডন ব্রিজে হামলায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। গত ২৪ মে ভয়াবহ আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটে ম্যানচেস্টারে। এতে ২২ জন নিহত ও ১১৯ জন আহত হয়। ঘটনাগুলো ব্রিটেনে বিস্ময় বিমূঢ়তা সৃষ্টি করেছে। ব্রিটেনের জনগণের সামনে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য লাভ করে। বিষয়টি কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে এবং বিরোধী দলের নেতা জেরেমি করবিন নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিশ্রুতির প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন। জনগণের সামনে এখন প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কার ওপর বেশি ভরসা যায়, সে বিষয়টি। ক্ষমতাসীন রক্ষনশীল দল প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, উগ্রবাদ দমনে সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য তারা একটি বিধিবদ্ধ স্বাধীন কমিশন গঠন করবে। প্রস্তাবিত কমিশনের কাজ হবে ব্রিটিশ মূল্যবোধের প্রচার এবং উগ্রবাদকে চ্যালেঞ্জ করা। বিশেষ করে তাঁরা দেখবেন, কী করে সংঘাতমুক্ত উপায়ে সন্ত্রাস দূর করা যায়।
উভয় পক্ষের রাজনৈতিক নেতৃত্ব মনে করে, যুক্তরাজ্য বিশ্বে অন্যতম সফল বহুধর্ম, বর্ণ ও সংস্কৃতির দেশ। কিন্তু বহু সংস্কৃতি উদযাপনের ঐতিহ্য নিশ্চয়ই ঘৃণ্য উগ্রবাদ দমনে বাধা হতে পারে না; যদিও কাজটি কঠিন এবং কখনো কখনো বিব্রতকর। লেবার পার্টি জোরেশোরে প্রচার করছে যে, বিরোধী শ্রমিকদল নেতা জেরেমি করবিন সাম্প্রতিক অতীতে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। সুতরাং করবিনের হাতে দেশ নিরাপদ নয়। আর করবিন উল্টো অভিযোগ করছেন, গত সাত বছর ক্ষমতাসীন রক্ষণশীলরা নিরাপত্তা বাজেট হ্রাস করায় পুলিশের সংখ্যা অন্তত বিশ হাজার কমে গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পর্যাপ্ত রসদের অভাবে নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়েছে। ক্ষমতাসীন দল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী শক্তি হিসেবে পৃথিবীর সর্বত্র ক্ষমতার জানান দিতে চায়। শ্রমিকদল নেতা যুদ্ধবিরোধী উদারনৈতিক জেরিমি করবিন এসবের বিরোধিতা করছেন। অতীতের নির্বাচনসমূহে তিনি পরনির্ভশীল পররাষ্ট্রনীতির বিরোধিতা করেছেন। এখন তিনি স্পষ্ট করে বলছেন, বিদেশে যুদ্ধ যুক্তরাজ্যে সন্ত্রাসের ঝুঁকি বাড়িয়েছে। তিনি উদ্ধৃত করছেন বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের গবেষণা কর্ম এবং পেশাদার গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলো। এসব গবেষণাকর্মের ফলাফলে বলা হয় যে, সন্ত্রাসবাদ দমনের প্রচলিত যুদ্ধনীতি ব্যর্থ হয়েছে।
ঐসব যুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে ব্রিটেনে সন্ত্রাসের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। জেরেমি করবিন ঘোষণা দিয়েছেন যে, ক্ষমতায় গেলে তিনি পররাষ্ট্রনীতি ঢেলে সাজাবেন। এই শ্রমিকদল নেতা আরো বলেন, তাঁর প্রস্তাবিত পররাষ্ট্রনীতি দেশে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াবে না, বরং কমাবে। ম্যানচেস্টারে হতাহত ব্যক্তিদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে তিনি বলেন, সন্ত্রাসবাদের ব্যাখ্যা যা-ই হোক না কেন, তা কোনোভাবেই হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেয় না। বরাবর শান্তি ও মানবাধিকারের পক্ষে বক্তব্য প্রদানকারী করবিন প্রতিশ্রুতি দেন যে, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে তাঁর দল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাজেট বাড়াবে। এতে তারা দায়িত্ব পালনে প্রয়োজনীয় সব উপকরণের সংস্থান করতে পারবে। আর বিদেশি সন্ত্রাসের ঝুঁকি কমাতে পররাষ্ট্রনীতিতে যুদ্ধ হবে শেষ অবলম্বন। যুদ্ধবিরোধী হিসেবে পরিচিত করবিন আফগানিস্তান ও ইরাকে হামলার তীব্র বিরোধিতা করেন।
উল্লেখ্য, তিনি সিরিয়া লিবিয়ায় হামলার বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। তবে তিনি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ‘যেকোনো কঠোর সিদ্ধান্ত’ নিতে পিছপা হবেন না। করবিন তাঁর বক্তব্যের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে বলেন, কোনো সরকারের পক্ষেই সন্ত্রাসের ঝুঁকি শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। এসবের উত্তরে সরকারি দলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এম্বার রাড বলেন, বাজেট হ্রাসের কারণে সন্ত্রাসের ঝুঁকি বেড়েছে এ দাবি ঠিক নয়। আর নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বেন ওয়ালেস অভিযোগ করেন ম্যানচেস্টারের ঘটনা নিয়ে করবিন রাজত্ব করছেন।
পশিচমা দেশগুলোতে বিশেষত মার্কিন মুলুকে প্রচলিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকেন্দ্রিক বিতর্ক অনুষ্ঠান এখন ব্রিটেনেও সংক্রমিত হয়েছে। ইতিমধ্যে স্কাই নিউজ ও চ্যানেল ফোর-এর যৌথ প্রযোজনায় মে এবং করবিন আলাদাভাবে প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশগ্রহণ করেন। এর আগে টেরিজা মে মার্কিন স্টাইলে টেলিভিশন বিতর্ক অনুষ্ঠানে সম্মত হননি। উত্তরে করবিন বলেছিলেন,‘ টেরিজা মে ইন্টারভিউ ছাড়াই চাকরি নিতে চাইছেন।’ পরে নাগরিক সাধারনের প্রশের উত্তর দিতে রাজি হন তিনি। এতেই তাঁর জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাটা লক্ষ করা যায়। রক্ষণশীল সরকারের বিগত সাত বছরের পর্যালোচনা, ব্যর্থতা এবং বারবার নিজ মত পাল্টানো নিয়ে দর্শকদের প্রশ্নে বিব্রত হন টেরিজা মে।
সাত বছর ধরে নানা ধরনের কল্যাণসেবা বাতিল, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বাজেট কর্তন এবং নানাবিধ বিষয়ে যথার্থ উত্তর দিতে গলদঘর্ম হয়েছেন। এতে জনসাধারণের মধ্যে তার সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটিগুলো স্পষ্টতর হয়েছে। বিপরীতে শ্রমিকদল নেতা জেরেমি করবিন নিজের যুদ্ধবিরোধী অবস্থান এবং কট্টর বামপন্থী নীতির প্রশ্নে কঠিন সময় পার করলেও এগিয়ে থাকেন ‘সমাজ বদলের’ বিকল্প প্রস্তাব দিয়ে। দর্শকদের প্রশ্নে জবাবে করবিন বলেন, তিনি ব্রেক্সিট কার্যকর করবেন। তবে অভিবাসন কমানোর কোনো লক্ষ্য ঠিক করতে রাজি নন। কারণ, রক্ষণশীল দল লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে গত সাত বছরে তেমন কিছু করতে পারেনি। যুদ্ধনীতি বাদ প্রশ্নে করবিন বলেন, লিবিয়ায় পাশ্চাত্যের হামলা দেশটিকে সরকারহীন রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি সন্ত্রাস বাড়ায় এবং করো জন্য তা নিরাপদ নয়। মধ্যপ্রাচ্যের হামাসের মতো বিতর্কিত গোষ্ঠীগুলোর বিষয় করবিন বলেন, সংঘাত নয়, অলোচনার মাধ্যমেই সমাধানে বিশ্বাসী তিনি।
এসব বিষয়-আশয় পর্যালোচনায় আনতে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল আশঙ্কা করছে, ৮ জুন অনুষ্ঠিতব্য ব্রিটেনের জাতীয় নির্বাচনে পার্লামেন্টের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারেন প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে। এর অর্থ হলো রক্ষণশীল দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নাও পেতে পারে। আগের মতোই তারা কোয়ালিশন নির্ভর থাকতে পারে। এমনকি কম ব্যবধানে পরাজিত হলে শ্রমিক দলের জন্য সরকার গঠনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে রক্ষণশীল দলের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। গত নির্বাচনে যেমন অন্যদের সহযোগিতায় সরকার গঠন করেছে রক্ষণশীল দল, তেমনি করে কোয়ালিশনের সুযোগ পেতে পারে শ্রমিকদল। বেসরকারি জরিপ প্রতিষ্ঠান ‘ইউগভ’ যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, সেটি ভিত্তি করে এর পূর্বাভাস দেওয়া যায়। উল্লেখ্য, এর আগে পরিচালিত পৃথক জরিপে দেখা গিয়েছিল, আগাম নির্বাচনে বেশ বড় জয় পেতে যাচ্ছেন টেরিজা মে। তবে কথিত টেলিভিশন বিতর্কের পর তাঁর জনপ্রিয়তা সংকুচিত হয়ে আসে। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী শ্রমিক দলের নেতা করবিন নতুন নতুন কথা বলে দর্শকদের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছেন।
৫০ হাজার লোকের সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে তৈরি জরিপ প্রতিবেদনে ইউগভ জানায়, ২০১৫ সালের নির্বাচনে পূর্বসূরি ডেভিড ক্যামেরন পার্লামেন্টের ৬৫০টি আসনের মধ্যে ৩৩১টি আসনে জয়লাভ করেছিলেন। জরিপে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় যে, টেরিজা মে ২০টি আসন হারাতে পারেন। অপরদিকে লেবার পার্টি গতবারের চেয়ে এগিয়ে ২৫৭টি আসন পেতে পারে। গতবারের নির্বাচনে লেবার ২৩২টি আসন জিতেছিল। এসব হিসাব-নিকাশ উল্টে দিতে পারে টেরিজা মের সিংহাসন।
উল্লেখ্য যে, সরকার গঠন করতে হলে অন্তত ৩২৬টি আসনে জয় পেতে হবে। রক্ষণশীল দল এবং শ্রমিকদল—কেউই যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, তাহলে পার্লামেন্ট হবে ‘ঝুলন্ত’ বা হ্যাং। এর ফলে বর্তমান সময়ে চলমান অস্থিরতার অবসান না হয়ে বরং অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হতে পারে। গোটা বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের কার্যকারিতা ও প্রাতিষ্ঠানিকতার জন্য গণতন্ত্রে দোলনার দেশে দোদুল্যমানতার অবসান প্রয়োজন।
লেখক : অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।