ব্রিটেন নির্বাচন
বিজয়ের মুকুট কোন দিকে যাচ্ছে?
৮ জুন ব্রিটেনের সংসদ নির্বাচন। ব্রেক্সিট ট্রিগারের পর্যায়ে ব্রিটেনে একটি অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে, সেটি বছরখানেক আগে থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল। বহুবার অন্তর্বর্তী নির্বাচনের দাবি উঠলেও প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে এ ব্যাপারে ছিলেন নিশ্চুপ। কিন্তু হঠাৎ করেই গত ১৮ এপ্রিল নির্বাচনের ঘোষণা এলো। তার পর থেকেই রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের আনুকূল্য পেতে চষে বেড়াচ্ছে দেশটির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। ভোটারদের দিচ্ছে নানা রকম প্রতিশ্রুতি। লেবার, কনজারভেটিভ, এসএনপি, ইউকিপ, লিবডেমসহ প্রতিটি দল ভোটারদের মন জয় করতে নানা পরিকল্পনার কথা বলছে।
মূলত লেবার ও কনজারভেটিভ পার্টির দিকেই সবার দৃষ্টি। পাশাপাশি অন্য দলের সমালোচনাও চলছে সমানতালে। কয়েক দিন আগেই স্লোগান চলছিল ‘মে মাস শেষেই বিদায় দিন মে-কে’। যাঁরা এই স্লোগানে সমর্থন দিচ্ছিলেন কিংবা দিচ্ছেন, তাঁরা লেবার নেতা জেরেমি করবিনের জয় চাইছেন। বলা যায়, করবিন বেশ চাপে ফেলে দিয়েছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে-কে। অবশ্য নির্বাচনে এমনটা হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তবে প্রকৃতপক্ষে লেবার দলের চেয়ে রক্ষণশীলদের প্রতি মানুষের বেশি সমর্থন রয়েছে। এ কারণে অনেকেই নির্দ্বিধায় বলে দেন, রক্ষণশীলদের বিজয়ের কথা। বিশেষ করে লেবার এমপিদের নিজেদের মধ্যেও করবিনকে নিয়ে এক ধরনের ভাগাভাগি রয়েছে। কারণ, করবিন হলেন মার্কসের অনুসারী ‘কট্টরপন্থী’ লেবার মানুষ। উল্টো দিকে বেশির ভাগ লেবার এমপিই মুক্ত অর্থনীতির উদারবাদে নিজেদের নিমজ্জিত করেছেন। বিভিন্ন বিবেচনাতেই নির্বাচন নিয়ে ব্রিটিশদের কিছুটা মাথাব্যথা থেকেই যাচ্ছে। কয়েক দিন আগেও যে পরিস্থিতি ছিল, সেটি এখন নেই তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলে পরিচিত ব্রিটেনের রাজনীতিতেও রং বদলাতে খুব বেশি সময় লাগে না।
বর্তমান সময়ে ব্রিটেন বিভিন্ন কারণেই একটি সংকটাবস্থায় নিমজ্জিত। এ জন্য নির্বাচনের ফল নিয়ে বিশেষ ভাবনার সুযোগও তৈরি হয়েছে। কয়েক দিন আগেও বিশ্লেষকরা স্পষ্ট বলে আসছিল রক্ষণশীলদের নিশ্চিত বিজয়ের কথা। বিশেষ করে কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলায় দেশের ভোটের রাজনীতিতে কোনো সমীকরণ আনবে কি না, সেটি নিয়ে এখন সংশয় তৈরি হয়েছে। ম্যানচেস্টারে রেলস্টেশনে গিয়ে নামলেই টের পাওয়া যায় শহরটি অস্বস্তিতে আছে। মাইকে সারাক্ষণই ঘোষণা করা হচ্ছে, সন্দেহজনক কিছু দেখলে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করতে।
ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চারদিকে পুলিশের সতর্ক দৃষ্টি। এরই মধ্যে ৪ জুন বাংলাদেশ সময় ভোর পৌনে ৪টার দিকে লন্ডনে আরো একটি সন্ত্রাসী হামলা ঘটে গেল। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে সাতজন নিহত হন। ম্যানচেস্টারে হামলার রেশ কাটতে না কাটতেই নির্বাচনের মাত্র চার দিন আগে লন্ডনে এমন হামলার ঘটনা সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। এর আগে গত ২২ মে অ্যারেনাতে কনসার্ট চলছিল। মার্কিন শিল্পী আরিয়ানা গ্রান্ডে তাঁর অনুষ্ঠান শেষ করার সঙ্গেই সেখানে বিস্ফোরণ ঘটায় এক তরুণ। এতে ২২ জন প্রাণ হারায়, যাদের বেশিরভাগই শিশু। এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পর ব্রিটেনের মুক্ত ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতেও কি এই ঘটনা কোনো ধরনের বিধিনিষেধ টেনে দিতে পারে? নাকি কোনো প্রভাব পড়তে পারে ৮ জুন অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনের ওপর।
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, নির্বাচনের আগে সেনাবাহিনী নামিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির কোনো চেষ্টা চলছে কি না? কিন্তু তাতে আসলে কার লাভ হবে, পাল্টা প্রশ্নও উঠছে। তবে ম্যানচেস্টার এবং অতি সম্প্রতি লন্ডন হামলার ঘটনা ব্রিটেনের রাজনীতি, নির্বাচন ও ভবিষ্যৎকে অনেকটাই এলোমেলো করে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা যাচ্ছে। বিশেষ করে কোনো পক্ষ এই হামলাগুলোকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে নির্বাচনে সংখ্যাগুরু ভোটারদের ভোটব্যাংক দখল করতে পারবে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তবে এ মুহূর্তে গোটা দেশেই আতঙ্ক বিরাজ করছে এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে যাতে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় থাকে, সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমের মাধ্যমে বারবার আহ্বান জানানো হচ্ছে। এরপরও নির্বাচনী রাজনীতিতে এর একটি প্রভাব থেকেই যেতে পারে।
বিভিন্ন কারণেই ব্রিটেনের বিরোধীদল লেবার পার্টি স্মরণকালের মধ্যে নেতৃত্বের জটিলতায় এখন সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে। সোশ্যাল বেনিফিট বা শুধু নাগরিক সুবিধার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দলটি নতুন প্রজন্মের ভোটারদের আগের মতো ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। গত দশকে আস্তে আস্তে বাম ধারার দল লেবার পার্টি ক্রমশ নেতৃত্বের পথ বেয়ে ডান ধারায় ঝুঁকছিল। আর দুনিয়াজুড়েই এক ধরনের জোয়ার ছিল উগ্র জাতীয়তাবাদের। সেটি কেবল যে যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প বা ইউরোপের কিছু দেশে, তা কিন্তু নয়। ভারতের সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনেও দেখেছি অভিন্ন চিত্র। ছিল বলছি এ কারণে, সম্প্রতি ফ্রান্স ও এর আগের বছরের শুরুতে নেদারল্যান্ডসের নির্বাচনেও অতি ডানদের পিছু হটা শুরু হয়েছে। লেবার দলের নেতৃত্ব নিয়ে ঘনীভূত সংকটের শতভাগ সুযোগ নিতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী টেরিজা। বিরোধী শিবিরের প্রতিকূল বাস্তবতাকে শতভাগ নিজের অনুকূলে কাজে লাগাতে চেয়েছেন তিনি।
এ কথাও সত্য, ব্রিটেনে জনগণ ভোট দেয় দলগুলোর মূলত ইশতেহার দেখে। শুধু শুরু থেকে ফেভারিট হিসেবে নয়, লন্ডনের গত মেয়র নির্বাচনে লেবার দলের সাদিক খানের জয়ের নেপথ্যে তাঁর হোপার টিকেট, হাউজিংয়ের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দেওয়া ইশতেহারটিও প্রভাবক ভূমিকা রাখে। যদিও শুরু থেকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী জ্যাক গোল্ডস্মিথ সাদিকের চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন। লন্ডনের বারগুলোর বেশির ভাগই লেবার অধ্যুষিত। সাদিক খান ওই নির্বাচনে ৫৬.৮ শতাংশ ভোট পান। গোল্ডস্মিথ পান ৪৩.২ শতাংশ। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে কোনো দলের এককভাবে সরকার গঠন করতে হলে ৬৫০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে জিততে হবে ৩২৬টি আসনে। গত নির্বাচনে কনজারভেটিভ ৩৩০ আর লেবার পার্টি ২২৯টি আসনে জেতে। মাত্র এক মাস আগের বিভিন্ন প্রাক-নির্বাচনী সমীক্ষায়ও দেখা যাচ্ছিল রক্ষণশীল আর লেবারদের মধ্যে ব্যবধান হতে পারে প্রায় ১৫ শতাংশ; কিন্তু মে মাসের শেষ দিনের সমীক্ষা বলছে, ব্যবধান কমে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫ শতাংশে। নির্বাচনী ভবিষ্যদ্বাণী করতে এই মুহূর্তে রীতিমতো ঘোল খেয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। গার্ডিয়ান পত্রিকা বলছে, মোট ৬৫০ আসনের সংসদ নির্বাচনে কোনো দলই পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। অর্থাৎ ৩২৬ আসন এককভাবে কেউ পাবে না। তাই লড়াইটা হচ্ছে হাড্ডাহাড্ডি।
অন্যদিকে, ব্রিটেনের ব্রেক্সিটের সিদ্ধান্তে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন দেশটিতে অবস্থানরত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অভিবাসী নাগরিকরা। সামনের দিনগুলোতে ভাগ্যে কী আছে, তা নিয়ে ব্যাপক আশঙ্কায় পড়েন ব্রিটেনে অবস্থানরত প্রায় ৩০ লাখ ইইউ নাগরিক। এসব নাগরিক অভিবাসনের মধ্য দিয়ে ব্রিটেনকেই বানিয়েছেন নিজেদের স্থায়ী আবাসভূমি। কিন্তু অনেকেরই সন্তান জন্মসূত্রে ব্রিটেনের নাগরিক। তা ছাড়া অনেকের পরিবার বা আত্মীয়স্বজন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, তাঁরা নিজ দেশে ছুটি কাটাতে গেলে ব্রিটেনে হয়তো ফেরার সুযোগ আর পাবেন না। কিংবা ব্রিটেন ইইউ সদস্য থাকার সময় স্বাস্থ্যসেবাসহ যেসব নাগরিক অধিকার তাঁরা পেতেন, তা থেকে বঞ্চিত হবেন। এমনকি ইইউ থেকে ব্রিটেন নিজের স্বার্থ আদায়ের কৌশল হিসেবে ইইউ নাগরিকদের হাতিয়ার করে তুলতে পারেন টেরিজা। লিসবন চুক্তির আর্টিক্যাল ফিফটি সক্রিয় করার পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এমপিদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি প্রত্যেক ইইউ নাগরিককে অধিকারের প্রতি খেয়াল রাখবেন বলে আশ্বাস দিলেও তাঁরা আশ্বস্ত হতে পারছে না। কারণ, আগে থেকেই তিনি বলে আসছেন, অভিবাসন আইন কঠোর করবেন।
ব্রিটেনের বিভিন্ন সংকটাবস্থা ও পরিস্থিতি বিশ্লেষণে এখনই বলে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না যে, বিজয়ের মুকুট কোন দিকে যাচ্ছে। নির্বাচনের ফলাফল কেমন হবে, তা কয়েক দিন আগেও কিছুটা অনুমান করা যাচ্ছিল। কিন্তু এখন সেই অনুমানটা ঘুরেও যেতে পারে। কাজেই আগামী ৮ জুন পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে নির্বাচনী সমীকরণ বুঝতে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।