আন্তর্জাতিক
কাতারের প্রতি সৌদি আরবের আগ্রাসী দৃষ্টি কেন?
কাতার সংকট সমাধানে আলজাজিরা টেলিভিশন বন্ধ, তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি তুলে দেওয়া ও ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক হ্রাস করাসহ সৌদি জোটের ১৩টি দাবি ছিল। সময়সীমাও নির্ধারণ করে দিয়েছিল। কিন্তু সেই দাবি মেনে নেয়নি কাতার। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে শর্ত পূরণ না করায় কাতারের ওপর আরোপ করা অবরোধ অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে সৌদি আরব।
কাতার কোনো শর্ত পূরণ না করেই আলোচনা কিংবা সংলাপের মাধ্যমে এর সমাধান চায়। অন্যদিকে উপসাগরীয় দেশের কর্মকর্তারা জানিয়ে দিয়েছেন, শর্তগুলো নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই। এ প্রসেঙ্গ সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, কাতারের বিরুদ্ধে আরো পদক্ষেপ যথাযথ সময়ে নেওয়া হবে এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী হবে।
সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন, আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অভিযোগে গত ৫ জুন কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কচ্ছেদ করার পর থেকে নজিরবিহীন কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে কাতারকে চাপে রেখেছে সৌদি আরব ও তার মিত্র আরব দেশগুলো। প্রায় ৯৮ শতাংশ খাদ্য আমদানি করা দেশ কাতার সম্পর্কচ্ছেদের কারণে রীতিমতো খাদ্য সংকটে পড়ে যায়। ওই সময় ইরান ও তুরস্ক খাদ্য ও অন্যান্য সহায়তা নিয়ে দেশটির পাশে দাঁড়ায়।
বর্তমান ঘনীভূত সংকটাবস্থায় কাতার কি সংলাপের মাধ্যমে সৌদি জোটের সমঝোতায় পৌঁছাতে পারবে নাকি নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে যাচ্ছে দেশটি? এমন প্রশ্নই আমাদের সামনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
উপসাগরীয় সংবাদমাধ্যমগুলো আভাস দিয়েছে, কাতারের সন্তোষজনক সাড়া না হলে দেশটিকে আরো কঠোর অবরোধের মুখোমুখি হতে পারে। গত ৫ জুলাই এক প্রতিবেদনে আবুধাবি সরকার-সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্র আল-ইত্তিহাদের সম্পাদকীয়কে বলা হয়, ‘উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজস্ব স্বপ্ন আর বিভ্রম নিয়ে একাকী হাঁটছে কাতার।’ প্রকৃতপক্ষে এখন পর্যন্ত যে ধরনের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে তাতে বোঝা যাচ্ছে, কাতার তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে শত্রুতা বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং উপসাগরীয় ও আরব অঞ্চলের যৌথ কর্মকাণ্ডকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে।
সৌদি জোটের শর্ত মেনে ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক কমিয়ে আনতে পাল্টা শর্ত সাপেক্ষে সম্মতি দিয়েছে দোহা। পাল্টা শর্তে অন্য উপসাগরীয় দেশগুলোকেও ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক হ্রাসের অঙ্গীকার করতে বলা হয়েছে। কেবল ইরান প্রশ্নে সমঝোতায় পৌঁছালে কি কাতার নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি পাচ্ছে? আলজাজিরা বন্ধ করাসহ অন্য শর্তগুলোর কী হবে? তবে কয়েকটি শর্ত মানা কাতারের পক্ষে মোটেও সম্ভব ছিল না। সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের পক্ষ থেকে কাতারকে মুসলিম ব্রাদারহুড এবং হামাসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার শর্ত দেওয়া হয়েছে। ফলে শর্ত মানার বিষয়টি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আশঙ্কা করা যাচ্ছে, কাতারের ওপর চাপ আরো জোরালো করাটা পরবর্তী পদক্ষেপ হতে পারে। সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও তেমন আভাস মিলেছে। মূলত কাতার আরোপিত শর্তগুলোকে অবাস্তব এবং অগ্রহণযোগ্য বলে দাবি করেছে। তেল-গ্যাসে সমৃদ্ধ ২৭ লাখ মানুষের দেশ কাতার তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটায় আমদানি করেই।
তিন দিকে সাগরবেষ্টিত কিন্তু সমুদ্রবন্দরহীন দেশটি ভূখণ্ডের কারণে সৌদি আরবের ওপর নির্ভরশীল। ফলে সৌদি আরব ও তার মিত্রদের নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটিতে টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় কাতার তাদের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস এলএনজির উৎপাদন ৩০ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে।
সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, কাতারকে চ্যালেঞ্জ করা ছাড়া এই অঞ্চলের দেশগুলোর আর করার কিছুই নেই। কাতার সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ডের প্রতি দৃষ্টিপাত করছে না। আমরা যেটা করছি সেটা কাতারকে আঘাত করার জন্য নয়, বরং দেশটিকে সাহায্য করাই আমাদের উদ্দেশ্য। কাতারকে একঘরে করা দেশগুলোর কূটনীতিকরা বলছেন, বিদ্যমান পরিস্থিতির তাৎপর্য অনুধাবনে কাতার ব্যর্থ হয়েছে। একই সঙ্গে কাতারের রাজনীতিতে পরিবর্তনেরও আহ্বান জানিয়েছে দেশগুলো।
চার দেশের বিবৃতি দেওয়ার আগে লন্ডনে অবস্থানরত কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, অবরোধ আরোপ করা কাতারের ওপর স্পষ্ট আগ্রাসন ও দেশকে অপমানিত করার শামিল। তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে যে মতপার্থক্য রয়েছে তার জবাব অবরোধ হতে পারে না, জবাব হবে সংলাপ ও যুক্তি।’ কাতার মনে করছে, এগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ। তারা সংকট নিরসনের যেকোনো পদক্ষেপকে স্বাগত জানাতে চায়। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ কোনভাবেই মানতে চায় না।
দেশগুলো যদি সমস্যা সমাধানে কোনো ফলপ্রদ আলোচনায় বসতে না পারে, তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য নেতিবাচক নজির স্থাপন হবে। ফলে বিশ্বের যেকোনো দেশ ভবিষ্যতে এ সমস্যায় পড়তে পারে বলে করছে কাতার। এ মুহূর্তে কোনো আলোচনায় না বসে সৌদির আগ্রাসী মনোভাব ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষ করে অবরোধ আরোপের পর থেকেই তারা সব সময় কাতারকে আক্রমণের জন্য ওত পেতে থেকেছে। আমরা মনে করি, আন্তর্জাতিক আইন মেনে উদ্ভূত সংকট সমাধানে সব পক্ষকে এগিয়ে আসা উচিত। কোনো পক্ষই যেন একগুঁয়ে মনোভাবে না থাকে, সেটি আমাদের প্রত্যাশা। আলোচনার মাধ্যমে সমাধান না হলে এই সংকটাবস্থা আন্তর্জাতিকভাবে বৃহৎ ইস্যুতে পরিণত হতে পারে। কাজেই সব পক্ষকে আগ্রাসী মনোভাব পরিত্যাগ করে সহনশীল ও ন্যায্য ভূমিকা পালন করাই শ্রেয়।
লেখক : ড. সুলতান মাহমুদ রানা, সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।