রামনাথ কোবিন্দ
রাজনীতির আবেগ ও ভারতীয় গণতন্ত্রের মহত্ত্ব
আধুনিককালে যদিও চিন্তার প্রাগ্রসরতা ও যাপিত জীবনে জাতি, ধর্ম, গোত্র বা বর্ণভেদ-বৈষম্য বলে কিছু নেই, এমনটাই প্রচার করা হয়। আসলে এখনো আমাদের সমাজ-সংসারকে দলিত সম্প্রদায়ের দীর্ঘশ্বাস বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। জন্ম ও পেশাগত কারণে বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার মানুষরাই আন্তর্জাতিকভাবে দলিত হিসেবে পরিচিত। কামার, কুমোর, চর্মকার, ক্ষৌরকার, মুচি, ধোপা, কলু, হাজাম, বাইদ্যা, জেলে, পাটনি বা ঝাড়ুদাররা সমাজে অস্পৃশ্যতা ও পদদলনে পর্যুদস্ত হন। অবস্থাপন্নরা দলিতদের কাছ থেকে নানামুখী সেবা গ্রহণ করলেও প্রকৃত বিবেচনায় তাঁদের মনুষ্যগোত্রভুক্ত মনে করেন না। কথায় কথায় নির্যাতন বা নিপীড়ন দলিতদের নিত্যনিয়তি। আর এ অবস্থাটা বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের প্রেক্ষাপটে বিশ্বের অন্য জাতিগোষ্ঠীর তুলনায় ভয়ানকভাবেই বেশি। সেখানে দলিতরা ব্যবহৃত হন রাজনীতি রক্ষার ঘুঁটি হিসেবে। চুন থেকে পান খসলেই মারা পড়েন বেশুমার। এমন এক বাস্তবতায় ভারতের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো একজন দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ নির্বাচিত হলেন।
দেশের চতুর্দশ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে শাসক জোট এনডিএর প্রার্থী, ৭১ বছর বয়সী রামনাথ কোবিন্দ বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন। যিনি নির্বাচিত হয়ে নিজের জয়কে গণতন্ত্রের মহিমা বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ, দলিত সম্প্রদায়ের রামনাথ কোবিন্দের ধারণাতেই ছিল না তাঁর মতো মানুষ কখনো ভারতের রাষ্ট্রপতি হবেন। আজ ২৫ জুলাই ভারতের নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন রামনাথ কোবিন্দ। বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন তিনি।
খুব সাদাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত রামনাথ কোবিন্দ। তিনি ভারতের এমন এক পরিবার থেকে উঠে এসেছেন, যেখানে আবাল্য থেকেই অন্ন, বস্ত্র আর বাসস্থান না থাকার বেদনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে বড় হতে হয়েছে। মানুষ হিসেবে সামাজিক মর্যাদার ছিটেফোঁটাও না থাকার কারুণ্যকে সাথি করে বড় হতে হয়েছে।
গণমাধ্যমের সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, নির্বাচনে ৬৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ভারতের ১৪তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন রামনাথ কোবিন্দ। একসময়ের ভাঙা ঘরের বাসিন্দা কোবিন্দ কয়েক দিন পরেই ৩৪০ কক্ষবিশিষ্ট দুই লাখ বর্গফুট আয়তনের ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে উঠবেন। তাই শৈশবের সেই ভাঙা কুঁড়েঘর, চাল দিয়ে অনরবত বৃষ্টির পানির পড়ার কথা ভুলতে পারেননি তিনি। স্মৃতি তাঁকে বারবার পিছু টানে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর আবেগ সামলাতে পারেননি রামনাথ কোবিন্দ। সহজ ভাষায় সাবলীলভাবে বলে দিয়েছেন, ‘আমার জন্য এ এক আবেগী মুহূর্ত। আজ সকাল থেকে দিল্লিতে বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টি আমাকে শৈশবের কথা মনে করিয়ে দিল, যখন আমি আমার গ্রামে বাস করতাম। আমাদের ঘর ছিল কাঁচা, দেয়াল ছিল মাটির। বর্ষার সময় ঘরের চাল দিয়ে পানি পড়ত, আমরা সব ভাইবোন ঘরের এক কোণে গিয়ে দাঁড়াতাম; অপেক্ষা করতাম কখন বৃষ্টি থামবে।’
নিয়তির পরিহাস এমন যে, মাত্র মাসদেড়েক আগে বিহারের রাজ্যপাল থাকাকালীন সপরিবারে হিমাচল প্রদেশে বেড়াতে গিয়ে রামনাথ কোবিন্দ সিমলার কাছে রাষ্ট্রপতির সামার রিট্রিটে ঢুকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ভবনের অনুমতি নেই, এই যুক্তিতে রক্ষীরা তাঁকে গেট থেকে ফিরিয়ে দেয়। তখন তিনি ঘূর্ণাক্ষরেও জানতেন না ভাগ্যনিয়ন্তা তাঁকে ভারতের রাষ্ট্রপতির আসনে আসীন করছে খুব শিগগির! দেশের নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে সিমলার ওই রাজকীয় প্রাসাদই হবে তাঁর গ্রীষ্মকালীন অবকাশযাপনের ঠিকানা, যার গেট থেকে তাঁকে কিছুদিন আগেই ফিরে আসতে হয়েছিল!
কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসেও ভারতের রাজনীতির বাতাবরণটা এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে একধরনের আদিমতাতেই। অন্ধকারটাই এখনো ঘাপটি মেরে আছে সমাজ সংসারে। যেখানে আর্য ও অনার্যের পরিচয় নিয়ে রাজনীতি করা যায়। জাত-পাতের ভেদ বিভাজনকে কেন্দ্র করে জনগণের সহানুভূতি কাড়া যায়। ক্ষমতাসীন ও বিরোধীপক্ষ সবাই প্রমাণ করবার প্রয়াস পায় একমাত্র আমরাই বঞ্চনাক্লিষ্ট দলিতদের পক্ষে আছি। আমাদেরই ভোটটা দিন। দলিতরা এখনো এই আধুনিক যুগে এসেও রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচের অস্ত্র, নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত। নির্বাচনী প্রচারণায় সবাই ঘোষণা দেয়, নিম্নবর্ণ বা দলিতদের জন্য তারা অন্তপ্রাণ, কিন্তু দলিতকে সাধারণ সুবিধা, মর্যাদা ও অধিকারপ্রাপ্ত মানুষের কাতারে নিয়ে আসবার প্রয়াস কারোর মধ্যেই নেই। আর এ কারণেই দলিত সম্প্রদায়ের কেউ যদি ভারতের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ বা অন্য সাম্মানিক পদে অধিষ্ঠিত হন, তা প্রচার করা হয় ফলাও করে। তাকে বলা হয় গণতন্ত্রের মহিমা ও মহত্ত্ব। আসলে গণতন্ত্র তো হলো জনগণের দ্বারা নির্বাচিত, জনগণের জন্য নিবেদিত, জনগণের সরকার। সেখানে মানুষকে দলিত বা প্রাগ্রসর বলে বিভাজিত চিন্তার কোনো স্থান থাকবার কথা ছিল কি?
ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কানপুর দেহাত জেলার ঝিনঝাক গ্রাম থেকে উঠে আসা রামনাথ কোবিন্দ নিজেকে গোটা ভারতের গরিব ও কৃষকদের সঙ্গে তুলনা করেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি নিজের এই উত্তরণকে সেসব গবির মানুষের উত্তরণ বলে আখ্যা দেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে জানান, রাষ্ট্রপতি ভবনে তিনি তাঁদেরই প্রতিনিধিত্ব করবেন। কিন্তু বাস্তবতা আসলে তা নয়। একজন রাষ্ট্রপতি দলিত সম্প্রদায়ের হলো বলেই ভারতের চালচিত্র হঠাৎ করে বদলে যাবে না। এনডিএ জোট সরকারের আমলে ভারত এক নতুন শব্দকে ঘিরে উত্তাল হয়ে উঠেছে। শব্দটি হলো ‘গো-রক্ষক’। নেহাত খাদ্যাভ্যাসের কারণে গরুর মাংস খেতে চাইলে তাঁকে জনসমক্ষে পিটিয়ে খুন করা হচ্ছে। এমনকি মুসলমান নিম্নবর্গের কেউ বংশানুক্রমিক জীবিকা নির্বাহের কারণে মৃত গরুর চামড়া বা অন্যান্য অংশের ব্যবসা করলে তাঁদেরও গো-হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। কারণ গরু হলো গো-রক্ষকদের কাছে ‘মা’। কাজেই নিম্নবর্ণ, উচ্চবর্ণ, দলিত বা সংখ্যালঘু মুসলমানরা যুগ যুগ ধরে যেখানে ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, সেখানে একজন রাষ্ট্রপতি হুট করে সমাজ বদলে ভূমিকা রাখতে পারবেন না, এটাই বাস্তবতা।
ভারতের সমাজ রাজনীতি এখনো এমন যে দলিত ইস্যুতে সংসদে পর্যন্ত কথা বলতে বাধাপ্রাপ্ত হতে হয়। সম্প্রতি বহুজন সমাজ পার্টির দলিত নেত্রী মায়াবতীকে রাজ্যসভা থেকে পদত্যাগ পর্যন্ত করতে হয়েছে। সেখানকার সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতাই এমন যে বিভাজন যতটা বেশি জিইয়ে রাখা যাবে, নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া কিংবা ফায়দা তোলার সম্ভাবনা তত বেশি বাড়বে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন ২০১৯ সালের নির্বাচনকে লক্ষ্য করে একজন দলিত প্রার্থীকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দেন, তাঁর দেখাদেখি কংগ্রেসও তাদের প্রার্থী করে দলিত সম্প্রদায়ের মীরা কুমারকে। মোদির পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে কংগ্রেস তাদের ফলাফল ঘরে তুলতে পারেনি। আধুনিক সমাজে এসেও যখন দলিত ইস্যুকে সামনে এনে নির্বাচনে প্রার্থিতার ছক আঁকা হয়, তখনই আসলে প্রমাণ হয়ে ভারত তার অস্পৃশ্য অন্ধকার থেকে আলোতে ফিরতে পারেনি। ১৩০ কোটি মানুষের দেশ ভারতের ২০ কোটি মানুষ দলিত সম্প্রদায়ের। সেই দলিত সম্প্রদায়ের মুখপত্র হিসেবে একজন রাষ্ট্রপতি করা আর সত্যিকার অর্থে ভালোবেসে নিম্নবর্ণের মানুষের জন্য কাজ করা, এককথা নয়। তাই যদি হতো ভারতের দশম রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণও দলিত সম্প্রদায় থেকে প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন। নিম্নবর্ণের প্রতি অহংকারী উচ্চবর্ণের ঘৃণার ছিটেফোঁটাও কি তিনি কমাতে পেরেছিলেন? তাই এবারের দলিত সম্প্রদায়ের নতুন রাষ্ট্রপতিও সহস্র বছর ধরে চলে আসা মানুষে মানুষে হিংসা ও উন্নাসিকতার দাবানল নির্বাপিত করতে পারবেন, এমন বিশ্বাস কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষকও করবেন না।
তারপরও একজন ঝানু আইনজীবী, সাবেক রাজ্যসভা সদস্য, বিহার রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী ও গভর্নরের পরিচয় ছাপিয়ে ভারতের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে আসীন হয়ে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষকে ঔদার্য ও ভালোবাসায় দীক্ষা দিয়ে এককাতারে শামিল করতে সচেষ্ট হবেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ—এমনটাই আমরা প্রত্যাশা করি। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প পেছনে ফেলে মানুষের সমঅধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের রাইসিনা হিলসের নতুন জীবন হোক আলোয় উদ্ভাসিত।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।