নওয়াজ শরিফের পদত্যাগ
সংকটের মধ্যেও সম্ভাবনা
পানামা পেপারস মামলার রায়ে আদালত পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে ‘পদে থাকার অযোগ্য’ ঘোষণা করার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ পদত্যাগ করেছেন। আর এ পদত্যাগে স্পষ্ট হয়েছে যে, পাকিস্তানের রাজনীতিতে দীর্ঘদিনে বিদ্যমান সেনাবাহিনীর প্রভাবের পাশাপাশি বিচার বিভাগের প্রভাব সৃষ্টি হলো। তবে যেভাবেই হোক না কেন বিচার বিভাগের এ রায় এবং নওয়াজের পদত্যাগের পর পাকিস্তান গভীর রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে।
ইতিমধ্যেই যে পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে তা কোনো শুভ রাজনীতির লক্ষণ নয়। পাকিস্তানের রাজনীতিতে বেসামরিকদের পূর্ণ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীত্ব শেষ করতে না পারার বিষয়টি চিরাচরিত। ইতিপূর্বে ১৭ জন প্রধানমন্ত্রীর কেউই পুরো মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। তবে এবারে বিশেষভাবে যে বিষয়টি লক্ষণীয়, সেটি হলো দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে উচ্চ আদালতের সাহসী এবং যথাযথ পদক্ষেপ। যেকোনো রাষ্ট্রেই বিচার বিভাগ শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারলে দুর্নীতি রোধ করে নাগরিক স্বাধীনতায় উৎকর্ষতা আনা সহজ হয়। আর এ কারণেই সংকটের মাঝেও অন্যতম সম্ভাবনা হলো- এমন যাত্রা অব্যাহত থাকলে পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন ধারার রাজনীতি থেকে উপযুক্ত পথে ফেরার সুযোগ তৈরি হলো।
আমরা ধারণা করতে পারি যে, নওয়াজ শরিফকে দিয়েই দুর্নীতির চক্র ভাঙার কাজ শুরু করল দেশটির উচ্চ আদালত। তবে এই পদত্যাগের ঘটনাতেই যে, নওয়াজের দিন শেষ হয়ে যাবে এমনটি ধারণা করা ঠিক হবে না। যদিও বিরোধী দলের নেতারা উল্লসিতভাব নিয়ে তেমনটিই চিন্তা করছেন। মূলত পাকিস্তানের রাজনীতিতে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকটই ওই দেশের গণতন্ত্রের অন্যতম বাধা। আগামী ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও মূলত এর আগ পর্যন্ত সরকার চালিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব কার ওপর বর্তাবে সেটিও এখন অন্যতম আলোচ্য। নওয়াজ পদত্যাগ করলেও তাঁর দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ (পিএমএল-এন) ক্ষমতায় থাকছে। অবশ্য নিঃসন্দেহে এটি ক্ষমতাসীন পাকিস্তান মুসলিম লীগের জন্য কঠিন সময়। তবে দলের সদস্যদের জন্য আশার বিষয় হলো দলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নওয়াজ শরিফেরই থাকবে। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী বাছাইয়ে তিনিই ভূমিকা রাখতে পারবেন। বলা যায়, তাঁর মনোনীত প্রার্থীরই পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তথ্যমন্ত্রী মরিয়ম আওরঙ্গজেব রায়ের পর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘নওয়াজের চেয়ার দরকার নেই। তাঁকে চতুর্থবারের মতো নির্বাচিত করা হবে , এমন দিন বেশি দূরে নেই।’ এর আগেও ১৯৯০ ও ১৯৯৯ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু দু’বারই প্রধানমন্ত্রী থেকে নওয়াজ পদচ্যুত হওয়া সত্ত্বেও ২০১৩ সালে আবার নির্বাচিত হন। ফলে তিনি যে পুনরায় নির্বাচিত হবেন না সেটি নিশ্চিত করে বলা যায় না।
তবে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বার বার হোচট খেলে সেটি নিশ্চয়ই দুঃখজনক। আর এই অবস্থা কোনোভাবেই গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে পারবে না। যেকোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন দুর্বল হয়ে পড়লেই সেনাবাহিনী কিংবা অন্য কোনো তৃতীয় শক্তি ক্ষমতায় হাত বসায়। পাকিস্তানের জন্য এমন পরিস্থিতি এখন চিরন্তন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো বলিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরি। আর সুষ্ঠু ও ইতিবাচক রাজনীতি তৈরি না হলে অনৈতিকতার ফাঁক দিয়ে কখনো সেনাবাহিনী, কখনো বা আদালত সেই ক্ষমতার হাল টেনে ধরবে এমনটিই স্বাভাবিক। তবে এটা শুধু পাকিস্তান নয়, যেকোনো দেশের জন্যই শিক্ষণীয় বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।