মধ্যপ্রাচ্যের নতুন শক্তি
কাতার-ইরান-তুরস্ক
কিছুদিন আগেও কাতারকে নিয়ে মানুষ ততটা ভাবেনি। মধ্যপ্রাচ্য একটি আন্তমহাদেশী অঞ্চল যা পশ্চিমে এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার দেশ মিসরের মাঝে সীমাবদ্ধ। বাহরাইন থেকে শুরু করে ইয়েমেন পর্যন্ত সর্বমোট ১৭টি দেশ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য গঠিত। এরই মধ্যে ১১ হাজার ৪৩৭ বর্গকিলোমিটার নিয়ে ক্ষুদ্র একটি দেশ, যেটা কি না বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মাথাপিছু আয়ের দেশ। বর্তমানে কাতারের মাথাপিছু আয় ১ লাখ ২৯ হাজার ৭২৬ ডলার। ভাবতেও অবাক লাগে। এই তো গত জুন মাসে কাতারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসে মদদ দেওয়ার অভিযোগে কাতারের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দেশটির ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে সৌদি আরব সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মিসর।
কাতারের সঙ্গে আমাদের অনেক অমিল থাকলেও একটি বিষয়ে মিল রয়েছে। আর তা হলো কাতারও ১৯৭১ সালে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। হালের অনৈতিক অবরোধ কাতারকে একটি আক্রমণাত্নক রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। বিশ্বের একটি অন্যতম টেলিভিশন নেটওয়ার্ক আল-জাজিরা কাতার থেকে সম্প্রচার করা হয়। বর্তমানে কাতার বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ।
কাতারের অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি বিরাট সমস্যা রয়েছে, যা এখন অপার সম্ভাবনায় রূপান্তরিত হতে চলেছে। কাতারের একটি মাত্র প্রতিবেশী রাষ্ট্র রয়েছে। সেটা হলো সৌদি আরব। আর সংগত কারণেই সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রতিবেশী রাষ্ট্র সৌদি আরবকে ঘিরেই পরিচালিত হতো। এমনকি কাতারের উট, ভেড়া, ঘোড়া প্রভৃতি পশুপালনের চারণভূমিও ছিল সৌদি আরব।
কাতারের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক খারাপ হওয়া কখনো চিন্তা করার বিষয় ছিল না। ১৯৯১ সালে সংঘটিত গালফ যুদ্ধে কাতার বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। বিশেষ করে ব্যাটল অব খাপজির সময় সৌদি আরবের ন্যাশনাল গার্ড যখন ইরাক সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করেছিল, কাতারে ট্যাংক বাহিনী বীরদর্পে তাদের কাভারিং ফায়ার প্রদান করেছিল। এমনকি কাতারের ভূমি ব্যবহার করে কানাডিয়ান সৈন্যরা যুদ্ধের সব প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। কাতারের বিমানঘাঁটি ব্যবহার করে মার্কিন ও ফ্রান্সের যুদ্ধবিমান পুরো মধ্যপ্রাচ্যের আকাশ কাপিয়েছিল। সেই কথা কারো অজানা নয়। এখানেই ঘটনা শেষ হয়ে যায়নি। ২০০৩ সালে দ্বিতীয় গালফ যুদ্ধে ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ড হেডকোয়ার্টার্স কাতারে স্থাপন করা হয়েছিল এবং কাতারই ছিল ইরাক আক্রমণে প্রধান আক্রমণ ক্ষেত্র। কাতার কি সৌদি আরবকে সাহায্য করেনি ? এই সেই কাতার যা ২০১১ সাল থেকে হুতি বিদ্রোহীদের যুদ্ধে ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরবকে সহায়তা করেছিল। আর এতসব অবদানের কথা অস্বীকার করে সৌদি আরবের হঠাৎ অর্থনৈতিক অবরোধের ঘটনা পুরো বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দিয়েছে।
কী ছিল কাতারের অপরাধ। কাতারকে আখ্যায়িত করা হয়েছে দুমুখো জাতি হিসেবে, যা একদিকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের সহায়তা করছে। অন্যদিকে অর্থ ও অস্ত্র জোগান দিয়ে সন্ত্রাসীদেরও সহায়তা করছে। পশ্চিমারা এখন কাতারকে “ক্লাব মেড ফর টেররিস্ট” নামে আখ্যায়িত করছে। ক্লাব মেড হলো একটি ফ্রান্সের কোম্পানি যা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে রিসোর্টের ব্যবসা করে। ইতোমধ্যে কাতারের বিরুদ্ধে আল-কায়েদা, আল নুসরা, আই এস ও হামাসকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য প্রদানের অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু কাতার বরাবরই তা অস্বীকার করে আসছে। কাতারের আমির শেখ তামিমের মতে, তারা ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামিদের সহায়তা করছে। তা করতে গিয়ে হামাসকে সহায়তা করা অপরাধ নয়।
কাতারের নিকট অর্থের কোনো অভাব নেই। কিন্তু একটি মাত্র প্রতিবেশী হওয়াতে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারে সমস্যা হচ্ছে মাত্র। কাতারের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব এই তিনি দিকেই রয়েছে পার্সিয়ান গালফ। পার্সিয়ান গালফের ভিতরে পূর্বে ইরান, আর ইরানের উত্তরে রয়েছে তুরস্কের সঙ্গে সীমান্ত। সুতরাং কাতারের স্থলপথ হিসেবে এখন একটি পথই খোলা রয়েছে। আর সে জন্যই ইরান ও তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন কাতারের সঙ্গে বাণিজ্য করার সুবিধার্থে ইরানের মধ্য দিয়ে স্থলপথ তৈরি করতে চায় তুরস্ক। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো কাতার সৌদি আরবের মতো সুন্নি সালাফি মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ। কিন্তু তা সত্ত্বেও শিয়া মতালম্বী ইরানের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন এখন সময়ের দাবি।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, সুন্নি মতালম্বী কাতার ও শিয়া মতালম্বী ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি অনিয়মের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর ফলে প্রাগৈতিহাসিক শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব অনেক প্রশমিত হবে। এতে তুরস্ক তাদের ব্যবসার স্বার্থে একটি মধ্যস্ততা দেশে অবতীর্ণ হবে। এই তিন দেশের মধ্যে ভবিষ্যতে সামরিক চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেননা সৌদি আরবের সঙ্গে এ দ্বন্দ্ব সহজেই মিটবে না বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তারই ফলশ্রুতিতে কাতারের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এখন সময়ের দাবি। তারা কাতারের এই সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে ইরান ও তুরস্ক সহায়তা করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এর ফলে অনেকটা ‘কান টানলে মাথা আসে’ এমন ধারণার ওপর ভিত্তি করে রাশিয়াও দৃশ্যপটে চলে আসবে ধারণা করা হচ্ছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সেদিন বেশি দূরে নয় যখন কাতার মধ্যপ্রাচ্যে একটি প্রভাবশালী রাষ্ট্রে পরিণত হবে। কেননা কাতারের অর্থের কোনো অভাব নেই। ইতোমধ্যে কাতারের আমির অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন কাতারকে শিগগিরই একটি উদার রাষ্ট্রে পরিণত করতে। কাতারে পর্যটন শিল্পের বিকাশ কুয়েতকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
লেখক : আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, সিলেটে উপপরিচালক (প্রশাসন ও হিসাব) হিসেবে কর্মরত।