মিয়ানমার
রোহিঙ্গা গেরিলাদের উত্থান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইঙ্গিত

গত ২৫ আগস্টের আক্রমণটি ছিল মুক্তিকামী রোহিঙ্গাদের প্রথম ঐতিহাসিক সমন্বিত আক্রমণ। আক্রমণের সময় ছিল রাত ১.০০ ঘটিকা। একই সময়ে ৩০টি বার্মিজ পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনাচৌকিতে সমন্বিত আক্রমণ করে বসে রোহিঙ্গা গেরিলা বাহিনী। ধারণা করা হয়, এতে ১১ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও ২১ জন গেরিলা বাহিনীর সদস্য নিহত হয়েছে। নিহত ১১ জনের মধ্যে ১০ জন ছিল পুলিশ ও একজন সেনাসদস্য ছিল।
মূলত বার্মিজ বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতি আক্রমণ শুরু হয় গত অক্টোবর ২০১৩ থেকে। এর আগে গেরিলারা বাংলাদেশের একটি আনসার ক্যাম্প লুট করে। লুটকৃত অস্ত্রের সাহায্যে তারা অক্টোবরের আক্রমণটি রচনা করে। ওই সময়ে রোহিঙ্গাদের এই গেরিলা বাহিনীর নাম ছিল হারাকাহ-আল-ইরাকিন বা ফেইথ মুভমেন্ট। এই নামটির সঙ্গে ধর্মীয় আবহ থাকার ফলে রোহিঙ্গা গেরিলারা এই নামটি পরিবর্তন করে রাখে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা।
প্রথম আক্রমণটি শুরু হয় রাত ১টার সময়। তারপর দ্বিতীয় আক্রমণটি হয় রাত ৩টায় এবং তৃতীয় আক্রমণটি পরিচালনা করা হয় রাত ৪টায়। হামলায় হাতে বানানো বোমা ও ক্ষুদ্রাস্ত্র ব্যবহার করা হয়।
অক্টোবর ২০১৬ আক্রমণের সঙ্গে আগস্ট ২০১৭-এর আক্রমণের অনেক পার্থক্য দৃশ্যমান। অক্টোবর ২০১৬ আক্রমণে বুথিডং প্রদেশের টং বাজার এলাকায় একটি সেনাচৌকিতে প্রায় ১৫০ জন রোহিঙ্গা গেরিলা আক্রমণ পরিচালনা করে। কিন্তু আগস্ট ২০১৭ আক্রমণে বুথিডং ছাড়াও মংডুতেও আক্রমণ রচনা করা হয়। প্রায় ১০০০ রোহিঙ্গা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ৩১টি পোস্টে একযোগে আক্রমণ রচনা করে। ক্ষুদ্রাস্ত্রের পাশাপাশি গেরিলারা লাঠি ও তলোয়ার ব্যাবহার করে এবং বিস্ফোরক দিয়ে একটি সেতু উড়িয়ে দেয়। আরসার বর্তমান নেতার নাম আতা-উল্লাহ। কিছুদিন আগেও রোহিঙ্গাদের অভিভাবকহীন সবচেয়ে নির্যাতিত মানুষ বলে ধরে নেওয়া হতো। বর্তমানে তাদের নেতা হিসেবে আতা-উল্লাহ নামের একজন রোহিঙ্গার আবির্ভাব হয়েছে। আতা-উল্লাহর আরো তিনটি নাম রয়েছে। সেগুলো হলো আবু আমর জুননী, আমির আবু ওমর ও হাফিজ তোহার। হতে পারে এগুলো তাঁর ছন্দ নাম।
নির্যাতিত রোহিঙ্গারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। তাদের একটি দল পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে। আতা-উল্লাহর পিতা পাকিস্তানের করাচিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। শিশুকালে আতা-উল্লাহকে তার পরিবার সৌদি আরবের মক্কায় নিয়ে যান। সেখানে একটি মাদ্রাসায় তাঁকে ভর্তি করা হয়।
২০১২ সালে আতা-উল্লাহ মক্কা নগরী থেকে পুনরায় পাকিস্তান চলে আসেন। সে বছর ৮ জুন ২০১২ সালে রায়ট শুরু হয়, ইতিহাসে যাকে ‘২০১২ রাখাইন স্টেট রায়ট’ নামে অভিহিত করা হয়। সে রায়টে প্রায় একশর মতো রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছিল। প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল।
খুব সম্ভবত ২০১২ সালের এই রায়টই আতা-উল্লাহ্কে রোহিঙ্গাদের নেতৃত্বে আসার জন্য প্রেরণা দেয়। পাকিস্তানের তালেবান প্রাথমিকভাবে আতা-উল্লাহ্কে গেরিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষণ প্রদান করে। পরবর্তীকালে আতা-উল্লাহকে আরো উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য লিবিয়ায় পাঠানো হয়।
প্রায় চার বছর কঠোর গেরিলা প্রশিক্ষণের পর ২০১৬ সালের কোনো একসময় তাকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে পাঠানো হয়।
গেরিলা যোদ্ধাদের নেতা হিসেবে আতা-উল্লাহর জন্য ৯ অক্টোবর ২০১৬ ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জিং দিন। সেদিন ছিল রোববার। রাত ঠিক ১টা ৩০ মিনিটে ৯০ জন গেরিলা যোদ্ধা আতা-উল্লাহর নেতৃত্বে মংডু শহরের কাইবানগিন গ্রামে অবস্থিত একটি পুলিশ পোস্টে আক্রমণ করে বসে। এই আক্রমণে ছয়জন পুলিশ অফিসার নিহত হয়। আরো দুজন আহত হয়। গেরিলারা এই আক্রমণে ৫১টি অস্ত্র লুট করে নিয়ে যায়। প্রায় ১০ হাজারের মতো গুলিও লুট করে নিয়ে যায়। ঠিক একই সময় রাথিডং শহরে কাইডাংগক গ্রামেও আরো একটি আক্রমণ রচনা করা হয়েছিল। আর রাত ৪টা ৩০ মিনিটে তৃতীয় আক্রমণটি রচনা করা হয়েছিল বুথিডংয়ে।
এই আক্রমণের সাফল্য খুব সম্ভবত আতা-উল্লাহ্কে আরো উৎসাহী করে তোলে। প্রায় নয় মাস ধরে নিঃসন্দেহে তারা অনেক অনেক প্রস্তুতি ও রেকি সম্পন্ন করেছিল। তারই ফল এই ২৪ আগস্টের আক্রমণ।
অক্টোবর ২০১৬-এর আক্রমণ থেকে আগস্ট ২০১৭ আক্রমণটিতে কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়েছে। এই পার্থক্যগুলো নিঃসন্দেহে অর্থপূর্ণ ও ইঙ্গিতবহ। এগুলো হতে পারে : (১) এটা ছিল রিটালিয়েশন, যা ছিল অনিবার্য। কারণ সকল মুক্তিযুদ্ধ এমন করেই শুরু হয়, (২) এ যুদ্ধ চূড়ান্ত বিজয়ের আগ পর্যন্ত থেমে যাওয়ার কথা নয়। এই আক্রমণের পর রোহিঙ্গা বৃদ্ধ, শিশু ও নারীরা বাংলাদেশের দিকে ধাবিত হলেও যুবকরা কিন্তু ফিরে আসেনি। তারা যুদ্ধরত আছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। (৩) বার্মিজরা এই প্রথমবারের মতো বাঙালি শব্দটি ব্যবহার করেছে। তারা বলেছে ‘বাঙালি সন্ত্রাসীরা’ এই আক্রমণ রচনা করেছে। এটা আমাদের জন্য হানিকর মন্তব্য। এটার সমুচিত জবাব এখন সময়ের দাবি। এরই মধ্যে ডিজি-বিজিবি সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বার্মার নিরাপত্তা বাহিনীর কোনো গুলি এলে তার সমুচিত জবাব দেওয়া হবে বলে তিনি হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। (৪) আতা-উল্লাহর সঙ্গে আরো ২০ জন প্রশিক্ষিত গেরিলা ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, তাদের সঙ্গে আছে জিয়াবুর রহমান নামের একজন সৌদি আরবের রোহিঙ্গা মুফতি। (৫) অতীতের চেয়েও আরসা আরো বেশি সংগঠিত এবং তাদের ফান্ডের অবস্থা ভালো। ধারণা করা হচ্ছে, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ইত্যাদি দেশ থেকে তারা সাহায্য পেয়ে থাকে। (৬) আরসা তাদেরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে মানতে নারাজ। তারা এখনো কোনো বেসামরিক কিংবা ধর্মীয় উপাসনালয় আক্রমণ করেনি। (৭) আরসার একটিই প্রধান উদ্দেশ্য আর তা হলো বার্মার ভেতরে নিজেদের নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অধিকার আদায় করা।
ভবিষ্যতে বার্মা-বাংলাদেশের ওপর অনেক মিথ্যা অভিযোগ আনতে পারে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন। যেকোনো গেরিলা যুদ্ধের জন্য তিনটি সহায়তা খুবই প্রয়োজন। সেগুলো হলো—(১) নিরাপদ আশ্রয়স্থল, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় সেফ হেভেন, (২) অস্ত্র সরবরাহ, (৩) গেরিলা যুদ্ধের ওপর প্রশিক্ষণ। বার্মা সরাসরি রোহিঙ্গাদের এসব প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপর মিথ্যা অভিযোগ আনতে পারে। সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
বর্তমানে রোহিঙ্গা গেরিলারা লুটের অস্ত্র ব্যবহার করছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সেফ হেভেন হিসেবে তারা নো-ম্যানস ল্যান্ড, বিশেষ করে ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তে ভারতের বিছিন্নতাবাদীদের কর্তৃক ব্যবহৃত ভূমি ব্যবহার করতে পারে।
রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সনদ না দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কক্সবাজার এলাকায় রেড অ্যালার্ট এরই মধ্যে জারি করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিত্ব প্রদানের কোনো প্রশ্নই আসে না। আমি যখন ইরাকে জাতিসংঘ মিশনে ছিলাম, তখন দেখেছি সাদ্দাম হোসেন সরকার অন্য দেশের নাগরিকদের নাগরিকত্ব দিলেও ফিলিস্তিনিদের নাগরিকত্ব দিত না। তাঁর মতে, ফিলিস্তিনিরা তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে যাবে। সুতরাং রোহিঙ্গারাও প্রয়োজনে যুদ্ধ করে নিজ দেশে ফেরত যাবে, এটাই অভিজ্ঞমহল মনে করে। আর তারই ফলেই শুরু হলো যেন ‘আরাকান মুক্তিযুদ্ধ’।
লেখক : সাবেক সেনা কর্মকর্তা। বর্তমানে এআইবিএ, সিলেটে কর্মরত।