শান্তিতে নোবেল
নোবেল শান্তি পুরস্কার পেল আইসিএএন
পারমাণবিক অস্ত্রের আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে বিশ্বের ন’টি দেশ। যদিও তারা এই অস্ত্রের বিস্তার রোধে অঙ্গীকারাবদ্ধ। কিন্তু মুখের অঙ্গীকার আর কার্যকারিতার ব্যবধান যোজন যোজন দূর। পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে সারাবিশ্বে দ্বিতীয়স্থানে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কনিষ্ঠতম পরমাণু শক্তিধর দেশ উত্তর কোরিয়ার মধ্যে এই মুহূর্তে চলছে সাপেনেউলে সম্পর্ক। উত্তর কোরিয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বলছেন উন্মাদ আর ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনকে সম্বোধন করেন রকেটম্যান বলে। এসব তিক্ততার মূল ইস্যু ওই পরমাণু অস্ত্র।
এমন এক বৈশ্বিক বাস্তবতায় বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করা সারা বিশ্বের একশ’টি দেশের বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত জোট ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু অ্যাবোলিশ নিউক্লিয়ার উইপন্স-আইসিএএন এবার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেল। তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) একটি জোট হিসেবে নিজেদের পরিচিতি দেয় আইসিএএন। কয়েক শত এনজিওর এই জোট প্রায় ১০ বছর ধরে শতাধিক দেশে কাজ করছে। জেনেভাভিত্তিক এই গোষ্ঠী অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম কাজ শুরু করে। ২০০৭ সালে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ভিয়েনায় কাজ শুরু করে।
সমরবিদ্যা, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বা নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা এই সংস্থাটির নাম জানলেও সাধারণের মধ্যে এর পরিচিতি খুব স্বল্পই। এমনকি এ বছর নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য যে ৩১৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে মনোনয়ন দেওয়া হয় তারমধ্যে কয়েকজন ব্যক্তি ও দু’টি সংস্থাকে শান্তি পুরস্কার পাওয়ার দাবিদার হিসেবে এগিয়ে রাখলেও আইএইএএনের নাম তেমন একটা শোনা যায়নি।
পুরস্কার ঘোষিত হওয়ার আগে প্রভাবশালী টাইম ম্যাগাজিন ও দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে রোমান ক্যাথলিকদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস; জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল; সিরিয়ার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হোয়াইট হেলমেটস এবং এর নেতা রিদ আল সালেহ; ইরানের পরমাণু চুক্তির মধ্যস্থতাকারী ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান ফেদরিকা মোগেরিনি ও ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফ, তুরস্কের ক্যান ডি এন্ডার এবং কামহুরিয়াত, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা, আমেরিকান সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়ন, রাইফ বাদাই এবং গাম্বিয়ায় শান্তি স্থাপনে ভূমিকা পালনকারী আঞ্চলিক জোট ইকোনমিক কমিউনিটি অব ওয়েস্ট আফ্রিকান স্টেটস (ইকোওয়াস) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু নোবেল পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে সুইডিশ একাডেমি বরাবর এতটা গোপনীয়তা রক্ষা করে যে এক্ষেত্রে ভবিষদ্বাণী খুব কম সময়ই ফলে। তার ওপর বিগত শতবর্ষ ধরে এমন সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে এবং অধিকতর যোগ্যদের বাদ হয়েছে যে, কড়া বিতর্ক ও সমালোচনা এই পুরস্কারের পিছু ছাড়েনি। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। যে সংস্থাকে শান্তি পুরস্কারের ভূষিত করা হলো তারা পরমাণু অস্ত্র নিরোধে সত্যিকার অর্থেই কতটা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে তা কেউ জানে না।
পরমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে কোনো গ্রুপ শান্তিতে নোবেল প্রাইজ পেলেই এই অস্ত্র নিষিদ্ধ বা নির্মূলের ক্ষেত্রে তা কোনো ভূমিকা রাখবে এমন ভাবনা খোদ নোবেল কমিটিরও হয়ত নেই। এর আগেও পরমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছে আরো একটি গ্রুপ। পাগওয়াশ গ্রুপ নামের একটি সংগঠনটিকে ১৯৯৫ সালে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরমাণু অস্ত্র সীমিতকরণক্ষেত্রে ওই সংগঠনের ভূমিকা তেমন কিছু আছে কি? তবু এ জাতীয় সংগঠনকে শান্তি পুরস্কার দেওয়ার একটাই কারণ এরা যাতে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ভয়াবহ দিক সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন করবার পাশাপাশি এর ব্যবহার বন্ধে আন্তর্জাতিকভাবে আইনি নিষেধাজ্ঞা জারির পক্ষে কাজ করতে পারে।
এবারের শান্তি পুরস্কার ঘোষণার পর নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আমরা এমন এক বিশ্বে বাস করছি, যেখানে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি৷ অনেক দেশ পারমাণবিক অস্ত্র আধুনিকীকরণের দিকে নজর দিয়েছে৷ আশঙ্কাজনকভাবে অনেক দেশ পারমাণবিক অস্ত্রের সম্ভার বাড়াতে সচেষ্ট, যেমনটা করছে উত্তর কোরিয়া৷’
স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউট বা এসআইপিআরআইর তথ্যানুযায়ী রাশিয়ার কাছে সবচেয়ে’ বেশি প্রায় সাত হাজার পারমাণবিক বোমা রয়েছে। ৬ হাজার ৮০০টি পারমাণবিক বোমা নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যারা যুদ্ধ্ব এই অস্ত্র ব্যবহারকারী একমাত্র দেশ। এরপর ফ্রান্স, চীন, যুক্তরাজ্য, পাকিস্তান, ভারত, ইসরায়েল ও ১০-১২টি বোমা নিয়ে উত্তর কোরিয়া আছে সবার নিচে। মজার ব্যাপার হলো এই তালিকায় শীর্ষে থাকা দেশগুলো তাদের পরমাণু বোমা খানিকটা কমিয়ে এনেছে। এস আই পি আর আই-এর আরেকটি প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ এই পাঁচ বছরে সারা বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ২২ হাজার ৬০০ থেকে কমে ১৫ হাজার ৮৫০ দাঁড়িয়েছে৷ পাঁচ বছরে মোট ছয় হাজার ৭৫০টি অস্ত্র কমে গেলেও এ নিয়া নিরাপত্তা গবেষকরা সন্তোষ বা স্বস্তি প্রকাশ করতে পারেননি৷ কারণ এসব দেশ পুরোনো হয়ে যাওয়া অস্ত্র বাতিল করেছে মাত্র। উপরন্তু তলে তলে সবাই নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার কর্মসূচিকে সমৃদ্ধই করে চলেছে।
নোবেল কমিটির মতে, ‘আইনি নিষেধাজ্ঞার ফলে একটি পারমাণবিক অস্ত্রও অপসারিত হবে না এবং যেসব রাষ্ট্রের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে বা তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধের চুক্তি সমর্থনও করে না৷ তবে পরবর্তী ধাপে পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ দেশগুলো এর ব্যবহার বন্ধে একমত হবে এমন আশা প্রকাশ করে নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সারা বিশ্বের প্রায় ১৫ হাজার পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে যার ব্যবহার বন্ধে জরুরি ভিত্তিতে আলোচনা করা প্রয়োজন।’
মূলত পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণে চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী প্রচেষ্টার জন্য আইসিএএনকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে নোবেল কমিটি। আইসিএএনের এমন প্রচেষ্টার মুখে গত জুলাইয়ে পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধ ও পর্যায়ক্রমে সেগুলো ধ্বংস করার জন্য প্রণীত জাতিসংঘের একটি চুক্তি ১২২টি দেশ গ্রহণ করে। কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী নয়টি দেশ এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। এর আগে আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে স্থল মাইন, গুচ্ছ বোমা, রাসায়নিক অস্ত্র বন্ধ করা সম্ভব হলেও এগুলোর চেয়ে বেশি ধ্বংসাত্মক হওয়া সত্ত্বেও পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধে অনুরূপ আন্তর্জাতিক আইনি নিষেধাজ্ঞা জারি সম্ভব হয়নি৷
এই পরিপ্রেক্ষিতে সমালোচকরা বলছেন, যাদের কাছে পরমাণু অস্ত্র আছে তারা যদি জাতিসংঘ প্রণীত পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধ বা ধ্বংসকরণ চুক্তি গ্রহণ না করে তাহলে কার্যত ওই চুক্তির কোনো মূল্য আসলে নেই। এমন অবস্থায় আইসিএএনকে পুরস্কার দেওয়া মানে হলো, শক্তিধর রাষ্ট্রের রোডম্যাপ মেনে নতুন করে অন্যকোনো রাষ্ট্রের পরমাণু অস্ত্রধারী হওয়া ঠেকানো এবং মার্কিন বা রাশিয়ার মতো দেশকে সুরক্ষা দেয়া। তারা এটা বলছেন, এ কারণে যে, নোবেল কমিটির ঘোষণায় সর্বকনিষ্ঠ পরমাণু শক্তিধর উত্তর কোরিয়ার নাম উল্লেখ করা হলেও বাকি আট দেশের কথা উচ্চারণ করা হয়নি। যদিও উত্তর কোরিয়ার দোষে দুষ্ট বিশ্বের অপর ৮ পরমাণু শক্তিধর দেশ। কাজেই এবারের শান্তি পুরস্কার প্রাপ্ত আইসিএএন-ও বরাবরের মতো বিতর্কিত বিজয়ীর তকমা থেকে রেহাই পাবে না।
পদার্থেবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের ভরের সমীকরণ সূত্র মেনে বানানো হয়েছিল পরমাণু বোমা। সেই বোমার প্রথম ব্যবহারে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি নরক হয়ে উঠলে এই বিজ্ঞানী ব্যথিত হয়েছিলেন। তবু তাঁর উপলব্ধি ছিল এমন যে, ভয় ছাড়া মানুষ বোধহয় কখনোই শান্তির পথে অগ্রসর হতে পারবে না। এখন এই ভয়ের ভারসাম্য নির্ধারণে ৯টি পরমাণু শক্তিধর দেশকে বাগে আনতে না পারা শান্তিতে নোবেল জয়ী ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু অ্যাবোলিশ নিউক্লিয়ার উইপন্স তথা আইসিএএনের ভূমিকাটা আসলে কীভাবে নির্ধারিত হবে?
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন