আন্তর্জাতিক
ট্রাম্পনীতি, বিশ্ব রাজনীতি ও অকার্যকর জাতিসংঘ
বিতর্কিত ও সমালোচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বান অগ্রাহ্য করে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। মূলত কয়েক দশকের মার্কিন নীতি পাল্টে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি বিনষ্ট হওয়ার প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানাতে হলো। এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে কোনো ইতিবাচক রাজনীতি খুঁজে পাওয়া না গেলেও নেতিবাচক রাজনীতির আভাস মিলছে যথেষ্ট। এককথায় বলা যেতে পারে, মার্কিন প্রেসিডেন্টের এ সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল।
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের যে প্রস্তাবের ভিত্তিতে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন ভেঙে একদিকে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল, অন্যদিকে আরব ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত হয়, তাতে জেরুজালেমের জন্য স্বতন্ত্র আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর ইসরায়েল পূর্ব ও পশ্চিম জেরুজালেম দখল করে নেয় এবং এককভাবে তা নিজ দেশের অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা দেয়। সেই অন্তর্ভুক্তি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কখনো মেনে নেয়নি। ১৯৯৫ সালে ইসরায়েল ও পিএলও স্বাক্ষরিত অসলো শান্তিচুক্তিতে উভয় পক্ষ মেনে নেয় যে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জেরুজালেমের প্রশ্নটি নির্ধারিত হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ২০০০ সালে হোয়াইট হাউসের লনে ইসরায়েলি নেতা র্যাবিন ও ফিলিস্তিন নেতা আরাফাত যে শান্তি কাঠামো স্বাক্ষর করেন, তাতেও এই প্রশ্নে উভয় পক্ষের সম্মতি ছিল। ১৯৯৫ সালেই মার্কিন কংগ্রেস অনুমোদিত এক আইনে ইসরায়েলের মার্কিন দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তর করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে সাবেক সব প্রেসিডেন্টই ক্ষমতায় থাকাকালীন ওই প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটালেন ট্রাম্প।
আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে জেরুজালেম শহরকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে বিক্ষোভ-সমাবেশ শুরু হয়েছে। শুধু ফিলিস্তিন কিংবা মধ্যপ্রাচ্য নয়, এই পদক্ষেপের সমালোচনা করে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন পশ্চিমা বিশ্বের নেতারা। বিশ্ব সম্প্রদায়ের সঙ্গে বাংলাদেশও ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এমনকি আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি আরব বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত ‘পুরো মুসলিম বিশ্বের জন্য চরম এক উসকানি’। এরই মধ্যে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে মার্কিন স্বীকৃতির প্রশ্নে ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) জরুরি বৈঠক আহ্বান করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান। সংস্থাটির বর্তমান সভাপতি দেশের প্রধান হিসেবে তিনি এ বৈঠক আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ১৩ ডিসেম্বর ওআইসির সদস্য দেশগুলোর নেতারা ইস্তাম্বুলে বৈঠকে বসবেন।
জেরুজালেমের অবস্থার যেকোনো পরিবর্তনের প্রভাব নানাবিধ এবং তা যেকোনো সময় আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে। প্রথম কথা, ধর্মীয় দিক থেকে জেরুজালেম বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর একটি শহর। ইসলাম, ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র ধর্মীয় স্থাপনার অনেকগুলোই এই শহরে। এ ছাড়া এর রাজনৈতিক গুরুত্ব হয়তো এখন ধর্মীয় গুরুত্বকেও ছাপিয়ে গেছে। নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইহুদিদের সমর্থন পেতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, জিতলে তিনি জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন এবং মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর করবেন। তিনি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রাখতে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে মারাত্মক বিপদ ডেকে আনলেন। আরব বিশ্ব ও অন্যান্য মার্কিন মিত্র দেশের আহ্বান ট্রাম্প উপেক্ষা করায় মিত্রদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ভাঙন ধরবে, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। ধারণা করা হচ্ছে, ইসরায়েলকে কাছে টানতে ও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ জিইয়ে রাখতে তার এ ঘোষণার পেছনে মার্কিন অস্ত্র ব্যবসা রমরমা করার গোপন উদ্দেশ্য থাকতে পারে। অস্ত্র ব্যবসার মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে এক ধরনের যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করাই কি তার লক্ষ্য?
ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়া বিঘ্ন ও বিশৃঙ্খলা তো দেখা দেবেই, পাশাপাশি সারা বিশ্ব এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যেকোনো ধরনের আলোচনার প্রধান ইস্যু হচ্ছে জেরুজালেম। দুই দেশই জেরুজালেমকে তাদের রাজধানী হিসেবে চায়। জাতিসংঘ পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিন অধিকৃত ভূখণ্ড মনে করে; কিন্তু সংস্থাটি মনে করে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে একদিন স্বীকৃতি পাবে জেরুজালেম। কিন্তু পবিত্র নগরী জেরুজালেম ১৯৬৭ সাল থেকে দখলে নিয়ে আছে তেলআবিব এবং তারা জেরুজালেমের ভাগাভাগি প্রত্যাখ্যান করে আসছে। মূলত ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের পেছনে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের বিপক্ষে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতি দেওয়ার পেছনে গভীর স্বার্থ রয়েছে, তাতে কারো কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।
অনেকেই মনে করেন, ট্রাম্প শান্তিতে আগ্রহী নন। আর সে কারণেই তিনি যেকোনো ধরনের সংকট বাড়াতেই বেশি আগ্রহী। এই সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়ার পথে বিরাট বাধা। এমনটি স্বয়ং ট্রাম্প জেনেবুঝেই যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে পরিষ্কার, তিনি শান্তি চান না। কারণ, এখন তুরস্কসহ বিশ্বের সব মুসলিম দেশেই ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন শুরু হবে। এমনকি মার্কিন এই সিদ্ধান্তের জেরে যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক সম্পর্ক গভীর সংকটে পড়বে।
কিন্তু এ সংকটাবস্থার ফলে বিশ্ব নেতৃত্বের কী ভূমিকা হবে? এর উত্তর খুব পরিষ্কার। সব পদক্ষেপই হবে অর্থহীন কিংবা কাগজে-কলমে। ইউরোপীয়রা নীতিগতভাবে ফিলিস্তিনের অধিকারের পক্ষে কথা বললেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সাহসী কোনো পদক্ষেপ তারা নেবে না। জাতিসংঘ আরো একটি অর্থহীন প্রস্তাব গ্রহণের চেষ্টা নেবে, যা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তিতে ভেস্তে যাবে। এ অবস্থায় নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় সব ভার বহন ফিলিস্তিনিদের একাই বহন করতে হবে। এতে আমাদের মনে বারবার একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খায় যে, বিশ্বশান্তি পুরোপুরি নষ্ট হওয়া পরও কি জাতিসংঘ কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে? নাকি যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গুলি নির্দেশে জাতিসংঘের ভূমিকা নির্ধারিত হতে থাকবে। আমরা চাই শান্তি। আর এই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের কার্যকর ভূমিকার পাশাপাশি বিশ্ব নেতৃত্বকে আন্তরিক ও ইতিবাচক রাজনীতির পথে হাঁটতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।