বিধানসভা নির্বাচন
ভারতের জাতীয় রাজনীতি কী ইঙ্গিত দেয়?
২০১৯ সালে ভারতের জাতীয় নির্বাচন। আর এই নির্বাচনের আগমুহূর্তে সদ্য সমাপ্ত গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন ভারতের রাজনীতিতে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আগামী জাতীয় নির্বাচন-পূর্ব হওয়ায় গোটা দেশ এই নির্বাচনী ফলাফলের দিকে তাকিয়ে ছিল। গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশে অনুষ্ঠিত বিধানসভা নির্বাচনে জয় পেয়েছে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)।
তবে তারা বিজয়ী হলেও এই ফলাফলটিতে বিশেষ দৃষ্টি নিবন্ধ করার সুযোগ রয়েছে। ভারতের রাজনীতিতে হিমাচল প্রদেশ কংগ্রেসের হাতে থাকলেও তা এবার হাতছাড়া হয়ে গেছে। তবে হিমাচল প্রদেশে প্রায় তিন দশক ধরেই প্রতি পাঁচ বছর অন্তর নিজেদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেয় কংগ্রেস ও বিজেপি। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কাজেই এ বিষয়টি স্বাভাবিক বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে গুজরাটে কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির আসন ব্যবধান কমে এসেছে। যদিও বিজেপি নেতারা আরো অনেক বেশি আসন প্রত্যাশা করেছিলেন। বর্তমান ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেসের যে দুর্দশা চলছে, তার মধ্য থেকে গুজরাটে কংগ্রেসের ফল তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো। ২০১৪ সাল থেকে দলটি রাজনীতিতে যেভাবে মার খাচ্ছে, সে হিসেবে গুজরাটকে কংগ্রেসের প্রত্যাবর্তন বলা যেতে পারে। দলটি আসন পেয়েছে ৮১টি। আগেরবারের চেয়ে ১৮টি বেশি। বিশেষ করে ভারতের গুজরাট নির্বাচনে দেড়শ আসন প্রত্যাশা করলেও ক্ষমতাসীন বিজেপি অনেক কম আসন পেয়েছে।
মোদি যত দিন রাজ্য থেকে নির্বাচন করেছেন, ততদিন গুজরাট নিয়ে বিজেপির কোনো সংকট ছিল না। কিন্তু এবার তারা যথেষ্ট চ্যালেঞ্জে পড়েছিল। তবে প্রমাণিত হলো, বিজেপিতে এখন মোদি ফ্যাক্টরই ভোট এনে দেয়। মোদি ছাড়া বিজেপির ভবিষ্যৎ কী তা সহজেই অনুমেয়। হয়তো গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের ফল বুঝিয়ে দিল মোদির নিজস্ব ‘ক্যারিশমা’ আজও অম্লান। অবশ্য এ কথা সত্য যে, ভারতের রাজনীতিতে মোদির নিজস্ব ‘ক্যারিশমা’ একটি ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে।
উল্লেখ্য, উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনেও অনেকে ভেবেছিলেন বিজেপি সরকার। একধরনের সংকট সৃষ্টি হয়েছিল ওই সময়। গোটা ভারতের রাজনীতির একটি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ওই নির্বাচনে প্রস্ফুটিত হওয়ার প্রত্যাশা ছিল অনেকের। কিন্তু সেটি ঘটেছে উল্টোভাবে। আমরা ধারণা করেছিলাম, নোটবন্দি নীতি, করনীতি এবং তাৎক্ষণিক তালাক রদ করার সিদ্ধান্ত মানুষ মেনে নেবে না। তালাক প্রথা রদ করার নীতিতে মুসলিম সম্প্রদায়ের ভোট ব্যাংক হাতছাড়া হয়ে যাবে বিজেপির। কিন্তু একেবারে উল্টো ঘটনা লক্ষ করলাম। বিপুল সংখ্যাধিক্যে জিতে যায় মোদি তথা বিজেপি।
গুজরাটে ষষ্ঠবারের জন্য ক্ষমতায় এলো বিজেপি। তবে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে চমক সৃষ্টি করেছে কংগ্রেস। ধারণা করা হচ্ছে, গ্রামীণ ভোট দখলে এলেও দলিত ও শহরের ভোট টানতে ব্যর্থ হয়েছে কংগ্রেস। গুজরাটের নির্বাচনে টানা ২২ বছর ক্ষমতায় থাকার জেরে প্রশাসনবিরোধী ভোটে বিজেপি ধাক্কা খেতে পারে বলে গত দুই মাস ধরে প্রচারের সময় জোর আলোচনা শোনা যাচ্ছিল। হাজার ও পাঁচশো টাকার নোট বাতিল, জিএসটি নিয়ে দেশজুড়ে আলোড়ন পড়লেও গুজরাটের শহরাঞ্চলের মানুষ ভোট দিয়েছেন বিজেপিকেই। শহরাঞ্চলের ৩৯টি আসনের মধ্যে ৩২টিতে জয় পেয়েছে বিজেপি। উত্তর, দক্ষিণ, মধ্য গুজরাট, সুরাত, রাজকোট, আহমেদাবাদ- সর্বত্রই বিজেপির জয়জয়কার। তবে কচ্ছ ও সৌরাষ্ট্রে দাপট দেখিয়েছে কংগ্রেস। লক্ষণীয়ভাবে যে ৬৫টি জায়গায় রাহুল গান্ধী প্রচার করেন, তার বেশির ভাগ জায়গাতেই জয়লাভ করেন বিজেপি প্রার্থী। প্যাটেল অধ্যুষিত ৩৭টি বিধান সভা কেন্দ্রের মধ্যে ২১টিতে জয়লাভ করে নরেন্দ্র মোদির দল। এ নিয়ে গুজরাটে টানা পাঁচবার ক্ষমতায় এলো বিজেপি। তবে যতটা হৈ চৈ করে তোলার কথা ছিল, সেটা ঘটেনি।
গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশ জিতেই ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের ডঙ্কা বাজাতে শুরু করেছেন বিজেপি নেতারা। রাজনৈতিক মহলের মতে, দেশের ১৯টি রাজ্যে ক্ষমতায় বিজেপি। আরো চারটি রাজ্যের নির্বাচনেও তারা ভালো করতে পারে। ফলে ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে বিরোধীদের জন্য কঠিন লড়াই অপেক্ষা করছে। আবার এ কথাও সত্য যে, গুজরাটের গ্রামগঞ্জে এবার সাড়া ফেলেছে কংগ্রেস। বিজেপি থেকে প্রায় ৬ শতাংশ বেশি ভোট গ্রামীণ এলাকায় পেয়েছে দলটি। খোদ মোদির রাজ্যে কংগ্রেস গতবারের তুলনায় ভালো ফল করল। গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশে ক্ষমতায় আসতে না পারলেও কংগ্রেস যেভাবে নিজেদের শক্তিকে দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরল, তাতে রাহুলের নেতৃত্বে ভারতের সুপ্রাচীন দল কংগ্রেসের আবার শক্তিশালী হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। পণ্য ও সেবা কর আইন (জিএসটি) প্রণয়নের পর ব্যবসায়ীদের প্রাণকেন্দ্র বলে পরিচিত এই সুরাট চলে গিয়েছিল বিজেপির বিরুদ্ধে। মোদির জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠতে থাকা ব্যক্তিত্ব এবং বর্তমানে অবিসংবাদিত নেতৃত্বের সমর্থন না থাকলে বিজেপির মতো বিশাল এবং শক্তিশালী দলও গুজরাটে জিততে পারত কি না সন্দেহ করলে ভুল হবে না। কাজেই আগামী জাতীয় নির্বাচনে শুধুমাত্র মোদির ‘ক্যারিসমা’ ফ্যাক্টরই বিজেপিকে ক্ষমতায় আনতে পারবে নাকি রাহুলের নেতৃত্ব কংগ্রেসকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়ক হবে- এমন প্রশ্নও আমাদের সামনে আসছে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।