আন্তর্জাতিক
ইরানে সাম্প্রতিক আন্দোলনের নেপথ্যে

সবার চোখ এখন ইরানের দিকে। গত ২৮ ডিসেম্বর থেকে তুর্কমেনিস্তান এবং আফগানিস্তান সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত সেই দেশটির দ্বিতীয় জনবহুল শহর মাশহাদে প্রতিবাদের আগুন জ্বলে ওঠে। এরপর তা দেশটির পশ্চিমে কারমেনশাহ এবং দক্ষিণে বন্দর আব্বাসে ছড়িয়ে পড়ে। রাজধানী তেহরানে এখনো এর আঁচ লাগেনি। এই প্রতিবাদ ২০০৯ সালের সবুজ আন্দোলন থেকে আলাদা, যেটিতে সংস্কারপন্থী নাগরিকরা নির্বাচনে কারচুপির প্রতিবাদে রাজপথে নেমে এসেছিল। এটি ১৯৯৯’র তেহরানে সংঘটিত ছাত্র বিক্ষোভ থেকেও আলাদা, যে আন্দোলন হয়েছিল সংস্কারপন্থী পত্রিকা সালামের বন্ধের প্রতিবাদে।
ঐসব বিদ্রোহ ছিল উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির, যাদের সামাজিক নিষেধাজ্ঞা এবং রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা টুঁটি চেপে ধরেছিল। তাদের আন্দোলন সফল পরিণতি পায় রাষ্ট্রপতি হিসেবে হাসান রৌহানি নির্বাচিত হওয়ায়। সামাজিক নিষেধাজ্ঞা অনেক শিথিল হয়েছে- নারীরা জনসমক্ষে পর্দা ছাড়াই বসতে পারে (তেহরানের পুলিশ গত বছরের প্রথমদিকে বলেছে তারা কোন নারীকে গ্রেপ্তার করছে না হিজাব না পরার অপরাধে)। এমন কি সংস্কারপন্থীদের কিছু কিছু রাজনৈতিক অধিকার দেওয়া হচ্ছে। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সচিব আলী শামখানি বলেছেন, বন্দি সংস্কারপন্থী নেতার ওপর যে বিধি-নিষেধ ছিল তার অনেকটাই তুলে নেওয়া হয়েছে।
এবার যে প্রতিবাদের ঢেউ ইরানে উঠেছে তা কোনো রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য নয়। তা আসলে ইরানে যে সংকটগুলো সৃষ্টি হয়েছে তার বিরুদ্ধে। এই বিদ্রোহ হচ্ছে বেকারত্ব, বঞ্চনা আর নৈরাশ্যের বিরুদ্ধে। যে স্লোগানগুলো ইরানের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দেওয়া হচ্ছে তা উঠতি তারুণ্যনির্ভর জনসমষ্টির মৌলিক চাহিদা মেটাতে ইসলামী প্রজাতন্ত্রটির ব্যর্থতাকেই নির্দেশ করছে। কারখানাগুলোতে এবং তেল প্রকল্পগুলোতে শ্রমিকশ্রেণি বিক্ষোভরত রয়েছে। তার সাথে যোগ দিয়েছে অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীরা এবং ব্যাংক সংকটে অর্থ হারিয়েছে এমন ব্যক্তিরা। প্রকৃত অর্থে এই বিদ্রোহ হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণি এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের—যারা তাদের জীবনমান নিচে নামতে দেখছে।
তেল বিপর্যয়
ভেনিজুয়েলা থেকে সৌদি আরবের মতো তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর যেই রকম সংকট তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে ইরানেও। সৌদি আরব এবং তার আরব মিত্রদের তেলে সমাতির কারণে ২০১৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে উল্লেখযোগ্য হারে তেলের দাম কমে গিয়েছে। ইরাকি এবং লিবীয় তেল উৎপাদন মার খাওয়ার পর সৌদি এবং এর আরব মিত্ররা ঘাটতি পুষিয়ে নিতে তৎপর হয়। তারা বিশ্ব চাহিদার সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। এর পিছনে তাদের রাজনৈতিক অভিলিপ্সা ছিল। কেননা এর ফলে তিনটি দেশ-ইরান, ভেনিজুয়েলা ও রাশিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পশ্চিম এবং সৌদি এই তিনটি দেশকে শত্রু মনে করে। তাই এটা পরিষ্কার যে এর পিছনে রাজনৈতিক চাল ছিল।
ভেনিজুয়েলায় যে অশান্তির আগুন জ্বলছে তারই সাদৃশ্য ঘটনা ঘটছে ইরানে। উভয় দেশই ১৯৪০ থেকে তাদের নিজস্ব উন্নয়নের জন্য তেল রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল, তেল ব্যতীত অন্য অর্থনীতির বিকাশ ঘটাতে ব্যর্থ এবং তাদের জাতীয় বাজেটের বেশিরই জনকল্যাণে ব্যয় করে। এই ধরনের ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে ১৯৭৮-৭৯ এর ইরানি বিপ্লব এবং ১৯৮৯-৯৯-এর ভেনিজুয়েলান বিপ্লবের মাধ্যমে। অবশ্য তাদের বিপ্লবের মতাদর্শিক ভিন্নতা রয়েছে- ইরানে ক্ষমতাসীন হয় ইসলামী মোল্লারা এবং ভেনিজুয়েলায় বলিভারিয়ান সমাজতন্ত্রীরা।
তাদের মতাদর্শিক ভিন্নতা থাকলেও তাদের শত্রু এক- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা। তাদের উভয়েরই ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবরোধ আরোপ করে। অবশ্য এই দুই দেশের অবরোধের তীব্রতায় ভিন্নতা রয়েছে, গত দশকে ইরানের ওপর অবরোধের মাত্রা ছিল তীব্র। দুই দেশই আঞ্চলিক অথবা বিকল্প বাণিজ্যিক সংযোগ তৈরি করে অবরোধ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ফলে তারা পশ্চিমাদের আর্থিক এবং বিনিয়োগের বেড়াজালের বাইরে অন্য কোনো বৈদেশিক বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে পারেনি।
চাহিদার ঊর্ধ্বগতি
ইরানের হাসান রৌহানি নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি জনগণের আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পায় যখন তারা ২০১৫ সালে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ এবং জাতিসংঘের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি করে। অবরোধের ফলে তারা ২০১২ সাল থেকে ১৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তেল রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। এই চুক্তি সেসব সাধারণ ইরানিদের স্বপ্ন দেখায়, যারা দেখছিল তাদের জীবনযাত্রার মান দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যৎ খুবই সংকীর্ণ। রৌহানি বলেছিলেন পারমাণবিক চুক্তি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকে আকর্ষিত করবে এবং ইরানকে ‘খুনে অবরোধে’র আমল থেকে মুক্ত করবে।
কিন্তু পারমাণবিক চুক্তির পরও অবস্থা একইরকম থেকে গেছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ট্রাম্পের নেতৃত্বে অপারমাণবিক অবরোধ আরো জোরদার করেছে। ট্রাম্পের এই বিরূপতা বিভিন্ন উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানকে ইরানের অভ্যন্তরে বিনিয়োগের আগ্রহকে বিনষ্ট করে দিয়েছে। তাই রৌহানির বাজি কাজে লাগেনি। ২০১৫ থেকে যে আশার ফানুস ইরানের মানুষের বুকে দানা বেধেছিল তা বাস্তবে কার্যকর হয়নি। ইরানের জনগণের যে সরকারি সাহায্য প্রয়োজন ছিল তার বেশিরভাই পূরণ হয়নি। আকাঙ্ক্ষার সামান্যই পূরণ হয়েছে।
গত ২০১৭-এর ডিসেম্বরের প্রথমদিকে রৌহানির সরকার তাঁর বাজেটের বিস্তারিত অংশ জনসম্মুখে প্রকাশ করে। রৌহানি তাঁর খসড়া বাজেটের এক তৃতীয়াংশের কম- ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং একটি নতুন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ব্যয় করার ইচ্ছে ব্যক্ত করেন। মুদ্রাস্ফীতি এখনো একটি বড় সমস্যা। আগামী বছর ৮,৪০,০০০ ইরানি যুবক কর্ম-প্রতিষ্ঠানে ঢুকবে।
রৌহানির বাজেটের ভালো দিকগুলো ম্লান হয়ে যায় যখন জনগণ দেখতে পেল যে একটা বিশাল অঙ্কের অর্থ যাচ্ছে মোল্লা নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানে। উদাহরণস্বরুপ, যে মাশাহাদ শহরে বিক্ষোভের শুরু সেই শহরে অবস্থিত ইরানের সবচেয়ে বড় ওয়াকফ আস্তান-ই-কুদস রাজাভী। এটি শহরের ৪৩% ভূমি অধিগ্রহণ করেছে এবং এর বাৎসরিক আয় ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৭ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনির প্রার্থী এবং আস্তান-ই-কুদস রাজাভীর প্রধান ইব্রাহীম রাইজি জনসম্মুখে বলেন, খামেনিই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন যাতে এই ওয়াকফকে কোনো কর দিতে না হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তেমনিই জনগণের জন্যও বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবমিলিয়ে এই ব্যাপারটি এখন সেইসব ইরানিদের কাছে কষ্টদায়ক হয়ে উঠেছে যারা পারমাণবিক চুক্তির ফলে লাভবান হয়নি।
২০১৬ সালে ইরানের প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে যায় এবং দেশটির চাহিদা মোটামুটি ভালোভাবেই পূরণ করা যায়। প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে সম্মানজনক ৭.৪% এ দাড়ায়। কিন্তু বিপদের কথা হলো তেল থেকে আয় বাদ দিলে প্রবৃদ্ধির হার মাত্র ০.৯%। দেশটির চালিকাশক্তি হলো তেল এবং তেলের দামের উপরই সে নির্ভরশীল। ১৯৭৯ তে ক্ষমতায় আসার আগে আয়েতুল্লাহ খোমেনি বলেছিলেন, ‘অর্থনীতি গাধাদের জন্য।’ ইসলামী প্রজাতন্ত্রটি ভেনিজুয়েলার বলিভারিয়ান সরকারের মত খুব কম চেষ্টাই করেছে অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনার এবং তেলত্তোর ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হওয়ার। এর স্বরাষ্ট্রনীতি এবং পররাষ্ট্রনীতি উভয়ই তেল রাজস্বের উপর নির্ভরশীল (লেবানীজ রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ এবং সিরিয়ার সরকারের প্রতি সমর্থনের ব্যাপারগুলোসহ)। ইরানের অর্থনৈতিক ক্ষমতা সুরক্ষিত না হওয়ার পিছনে প্রধান প্রতিবন্ধকতা তেলনির্ভর অর্থনীতি। এই বিষয়টি এখন সামনে চলে আসছে।
সরকারি পরিসংখ্যানে বেকারত্ব ১২.৭%, কিন্তু এটা খুবই বেঠিক একটি পরিসংখ্যান। ইরানের বিভিন্ন উৎস থেকে জানা যায় তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৫০% এর বেশি। মুদ্রাস্ফীতি ঠেকাতে সরকার ইতিমধ্যে জ্বালানী এবং রুটির উপর ভুর্তকী বাতিল করেছে। এইসব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম হু হু করে বাড়ছে। ২০১০ সালে দেশটির সরকার বৈশ্বিক নগদ অর্থ স্থানান্তরের পদ্ধতি গ্রহণ করায় দারিদ্র্যের হার ১৩.১%(২০০৯) থেকে কমে ৮.১%(২০১৩)-এ এসে পৌঁছেছিল। কিন্তু এই দারিদ্র্যের হার কমা ম্লান হয়ে গিয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধি পাওয়াতে। এমনকি সার্বিক মুদ্রাস্ফীতি কমার সুফলও পাওয়া যাচ্ছে না। ২০১৪ সাল থেকে দারিদ্র্যের হার আবার বাড়া শুরু করেছে। রৌহানির মুদ্রাস্ফীতি ঠেকানোর নীতি ইরানি শ্রমিকশ্রেণি এবং নিম্ন মধ্যবিত্তদের ওপর সরাসরি আঘাত হেনেছে।
ট্রাম্প এবং নেতানিয়াহু যেভাবে ইরানের বিদ্রোহে উসকানি দিচ্ছে তা খুবই দৃষ্টিকটু। মার্কিন-ইসরাইল নীতিই হলো- ইরানে যেন এমন আন্দোলন সৃষ্টি হয়। কিন্তু সবশেষে এই আন্দোলন- পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের অব্যাহত উসকানির ক্রীড়ানক নয়। রাজনৈতিকভাবে ট্রাম্প এবং নেতানিয়াহু ওবামার পারমাণবিক চুক্তির ফলে লাভবান হয়েছে; ইরানের সংকটের জন্য পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের কোনো দায় নেই।
হাজার হাজার লোক রাস্তায় নেমেছে। আবার বহু লোক সরকারকে রক্ষার জন্যও রাস্তায় নেমেছে। এটি ইরানের জন্য সংকটকাল। শ্রমিকশ্রেণির এই বিক্ষোভের ফলে দেশটির সরকার চাপে রয়েছে। বিক্ষোভকারীদের বিদেশের এজেন্ট বলে গালি দিলেই সমস্যার সমাধান হবে না। এমনকি ট্রাম্প এবং নেতানিয়াহু, রাজতন্ত্রী এবং মুজাহিদিন খালেক যতই বিক্ষোভের কৃতিত্ব নিতে চাক না কেন, বলতে গেলে তারা এর মধ্যে অনুপস্থিত। ইরানি দেশপ্রেম খুবই দৃঢ়। ইরানিরা হোয়াইট হাউজ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না, কিন্তু তারা ভবিষ্যতের নিরাপত্তা না পেলে ক্ষান্তও হবে না।
লেখক : আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক