শিশু নির্যাতন
এন্ড অব ইনোসেন্স...
সারা দিন শুধু চড়ুইপাখির মতো ছটফট করে ঘরময় ছুটে বেড়ায় ছোট্ট মেয়েটি। শুধু স্কুলে যাওয়ার কথা শুনলেই লক্ষ্মী মেয়ের মতো মায়ের সব কথা শোনে। মা খাইয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে পাড়ার সহপাঠীদের সঙ্গে স্কুলে পাঠিয়ে দেন। বেলা গড়িয়ে বিকেল নামে, তবুও মেয়ে স্কুল থেকে ফেরে না। অজানা আশঙ্কা বুকে চেপে মা খুঁজতে বেরোন, পাড়া-প্রতিবেশীরাও খুঁজতে থাকেন। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে মাঠের মধ্যে ঝোপের আড়ালে পাওয়া গেল ছোট্ট মেয়েটির লাশ। যে লাল ফিতে দিয়ে মা বেণী বেঁধে দিয়েছিল তার সোনামণির, সেই লাল ফিতে দিয়ে ওর ছোট্ট হাত দুটি বেঁধে রেখেছে পাষণ্ডরা। লাল ফিতে হাতে নিয়ে মা কাঁদতেও ভুলে যান, মরার আগে কত জানি কেঁদেছে মেয়েটা—মায়ের কাছে যাব বলে, মা কেন শুনতে পেল না ওর কান্না!...
চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে এই মর্মান্তিক শিশু ধর্ষণের ঘটনাটি বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। যখনই পত্রিকায় কোনো শিশু ধর্ষণের ঘটনা পড়ি, তখনই আমার চোখে ভেসে ওঠে সেই অসহায় শিশুটির মায়ের কান্না। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে খেলতে খেলতে দলছুট মেয়েটিকে একা পেয়ে পাড়ার কিছু বখাটে ছেলে ধর্ষণ করে, কান্নাকাটি থামাতে না পারায় মেরে রেখে যায়। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে একের পর এক শিশুহত্যার যে বীভৎস সব বিবরণ জানা যাচ্ছে, তাতে সুস্থ থাকাটাই এখন অস্বাভাবিক। মানুষ অনেক কিছুই ভুলে যেতে পারে বলে বেঁচে থাকতে পারে। তা না হলে প্রতিদিন সকালে খবরের কাগজ খুলে শিশুদের মেরে ফেলার ভয়ংকর সব খবর পড়ে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব হতো না। হঠাৎ করে কেন চারপাশের মানুষগুলো এমন নৃশংস খুনি হয়ে উঠেছে? সিলেটের শিশু রাজনকে অনেকটা সময় ধরে নির্যাতন করে মেরে ফেলল কয়েকজন মানুষ (!), সেই মেরে ফেলার দৃশ্য ভিডিও করেছে খুনিরা। একটা কবুতর চুরির অপরাধে ঢাকায় এক কিশোরকে কী ভয়াবহভাবে খুন করা হলো আর সেই খুনের দর্শক আরো বেশ কিছু মানুষ যারা ছেলেটিকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে রিয়েলিটি শো উপভোগ করলেন, কী ভয়ংকর! আমার কাছে তো মনে হয় খুনিদের চেয়েও দর্শক আরো বেশি হিংস্র, তারা উপভোগ করে এমন নিষ্ঠুরতা। খুলনার শিশুশ্রমিক রাকিবকে পেটে গ্যাস ঢুকিয়ে মারা হলো। বরগুনার রবিউল নামের শিশুটির চোখ উপড়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে। শিশু খুনের এমন আরো বীভৎস সব বিবরণ প্রায় প্রতিদিনই আমরা যা জানতে পারছি, তার আড়ালেও আছে আরো কত নির্যাতনের খবর, যা খবরের পাতায় আসছে না।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১২ সালে শিশু হত্যা হয়েছে ২০৯ জন, ২০১৩ সালে ২১৮, ২০১৪ সালে ৩৫০ এবং চলতি বছর জুলাই পর্যন্ত শিশু হত্যা হয়েছে ১৯১ জন। এ বছরের শুধু সাত মাসেই ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৩০টি শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৭টি শিশু, অপহৃত হয়েছে ১২৭ শিশু, অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৩ শিশুকে। ২০১৪ সালে অপহৃত হয়েছে ১১৮ শিশু, যার মধ্যে ৫০ জনকে মেরে ফেলা হয়েছে।
খুন, ধর্ষণ, অপহরণের মতো ভয়ংকর অপরাধ বাড়ছেই প্রতিনিয়ত। এসব ঘটনায় শুরুতেই পুলিশের মামলা নিতেই থাকে আপত্তি। তাদের গাফিলতি আর অবহেলায় যখন তদন্তের কাজ শুরু হয়, ততক্ষণে ঘটনার আলামত নষ্ট হয়ে যায়, অপরাধী পালিয়ে যাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ পেয়ে যায়। বেশির ভাগ হত্যারই তদন্তের কাজ শেষ হয়নি। এখানেই শেষ নয়। তদন্ত চলাকালীন সন্তান হারানো মা-বাবা আইনের গোলকধাঁধায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মামলা চালিয়ে যাওয়ার সাহস হারিয়ে ফেলেন। আর যদি অপরাধী কোনোভাবে ক্ষমতাশালী কেউ হয়, তাহলে তো কথাই নেই। নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে পরিবার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা দূরে থাক, উল্টো মামলা তুলে নেওয়ার সু (!)পরামর্শ দেন তাঁরা অসহায় পরিবারটিকে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধনীতে পরিষ্কার বলা আছে, মামলার ১৮০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে। কিন্তু বেশির ভাগ শিশু হত্যার মামলা বছরের পর বছর কোনো অগ্রগতি ছাড়াই ঝুলে থাকে, পরিবারের সদস্যরাও আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, আর্থিক বিষয়টিও এখানে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
শিশু হত্যা মামলাগুলোর আরেকটি বড় দুর্বল অংশ হচ্ছে ময়নাতদন্ত। ময়নাতদন্তের নামে পরিবারটিকে বারবার করে যেন হত্যা করা হয়। সরকারি খরচে ময়নাতদন্ত হওয়ার নিয়ম থাকলেও অনেক অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন। সাম্প্রতিক সময়ে কবুতর চুরির দায়ে খুন হওয়া কিশোর নাজিমের ময়নাতদন্ত করার খরচ তার মা-বাবাকে দিতে বাধ্য করেছে পুলিশ প্রশাসন। গণমাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসায় সাধারণ মানুষ জানতে পেরেছে, সাহায্য করার বদলে অসহায় পরিবারকে কতভাবে নির্যাতন করে পুলিশ। আর সে কারণেই কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে, কেউ গুম-অপহরণ বা হুমকি কিংবা ইভ টিজিংয়ের শিকার হলেও পুলিশের কাছে সাহায্যের জন্য যেতে চায় না। সাম্প্রতিক সময়ের শিশু হত্যার ঘটনাগুলোর ফলোআপ যদি পত্রিকাগুলো ঘেঁটে আমরা দেখি, তাহলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে মিডিয়ার চাপ থাকা সত্ত্বেও পুলিশ প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে মামলার অগ্রগতি হতে পারেনি। বিচারহীনতার এই উদাহরণ উসকে দিচ্ছে অপরাধীদের। সমাজে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হওয়ায় শিশু-কিশোর নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা বাড়ছে।
এ ধরনের নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনার শিকার হচ্ছে শিশুশ্রমিকরা। অভাবের তাড়নায় ছোট্ট শিশুরা পরিবারের আর্থিক সহায়ক হিসেবে যুক্ত হচ্ছে নানা কাজে। খুলনার রাকিব তার পারিশ্রমিক না পাওয়ায় অন্য জায়গায় কাজ নেওয়ায় নির্যাতনের শিকার হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে স্যুটকেসভর্তি ১১ বছরের এক কিশোরের বিকৃত লাশ পাওয়া যায়। আলামত দেখে পুলিশের ধারণা, গৃহকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিল শিশুটি। আর গৃহকর্মী কিশোরীদের ধর্ষণের ঘটনা সব সময় সংবাদমাধ্যম পর্যন্ত এসে পৌঁছায় না। তবে বিভিন্ন এনজিওর হিসাবমতে, গৃহকর্মী শিশুদের ৪০ শতাংশই শারীরিক নির্যাতন এবং ধর্ষণের শিকারও হয় তারা বেশি।
শুধু কি তাই, পারিবারিক সহিংসতারও বলি হচ্ছে শিশুরা। চাঁদপুরের সুমাইয়াকে জিনের প্রভাব আছে—এ দাবিতে পিটিয়ে হত্যা করে তার মা-বাবা। কক্সবাজারের চকরিয়ায় দাম্পত্য কলহের জের ধরে তিন মেয়েশিশুকে জবাই করে বাবা। সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজে ২১ দিন চিকিৎসার পর ছেলেশিশুটি সুস্থ হয়ে ওঠে গাড়িচালক ফজলুল হকের। কিন্তু হাসপাতালের বিলের পরিমাণ আড়াই লাখ হওয়ায় তা পরিশোধের কোনো উপায় না পেয়ে হাসপাতালের ছাদ থেকে ছুড়ে ফেলে শিশুটিকে হত্যা করে বাবা। একটি-দুটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, চলতি বছরের ছয় মাস সংবাদমাধ্যমের প্রকাশিত তথ্যের পরিসংখ্যান বলছে, এ পর্যন্ত মা-বাবার হাতে খুন হয়েছে ২৭ শিশু। প্রকৃত সংখ্যা হয়তো আরো বেশি। কিন্তু কেন এই বর্বরতা? সন্তানের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল মা-বাবা। কিন্তু মা-বাবাই যদি হন্তারক হন, তাহলে বর্বরতার কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে আমাদের সমাজ, তা বলার আর অবকাশ থাকে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভোগবাদী সংস্কৃতির সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে ভয়াবহভাবে। দাম্পত্য কলহ, যৌতুক, বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, মাদকাসক্তিসহ বিভিন্ন কারণে শিশু হত্যার মতো মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড আমাদের চারপাশে অহরহ ঘটছে। নৈতিক অবক্ষয় ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব মানুষকে হিংস্র করে তুলছে। ফলে বাড়ছে নৃশংসতা।
পারিপার্শ্বিকতা কীভাবে মানুষকে নৃশংস করে তোলে, তার ভয়ংকর চমৎকার একটি গল্প আমরা দেখি William Golding-এর লেখা Lord of the flies উপন্যাসে। এই উপন্যাসে দেখানো হয়, ভালো পরিবারের উন্নতমানের স্কুলপড়ুয়া একদল মার্কিন শিশু-কিশোর বিমান দুর্ঘটনায় একটি জনমানবহীন দ্বীপে আটকা পড়ে। সেখানে প্রতিদিনের বেঁচে থাকার সংগ্রাম করতে করতে ছোট্ট বাচ্চাগুলো কখন যে শিশুর সারল্য হারিয়ে ফেলে, তা তারা নিজেরাই বুঝতে পারে না। খাবারের জন্য নির্মমভাবে পশুহত্যা, নেতৃত্বের লড়াইয়ে সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুকেও খুন করার মতো পৈশাচিক হয়ে ওঠে তারা। একসময় তাদের উদ্ধারের জন্য সাহায্যকারীরা পৌঁছালে শিশুরা বুঝতে পারে, তারা কতটা বদলে গেছে, শৈশবের নিষ্পাপ সারল্য হারিয়ে তারা এখন অন্য মানুষ। তারা টের পায়, তাদের ‘end of innocence, the darkness of man’s heart’। সমাজের শিশুদের প্রতি যে নিষ্ঠুরতার ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছে, এর মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা শিশুগুলোর মানসিক কি পরিবর্তন হচ্ছে তার প্রতিফলনই আমরা দেখতে পাচ্ছি সমাজে। নির্যাতনের ফলে মৃত্যুর ঘটনা আমদের চোখের সামনে আসছে; কিন্তু প্রতিনিয়ত নির্যাতন সয়ে যে শিশুগুলো বেড়ে উঠছে, তার কি প্রতিফলন ঘটবে সমাজে—আমরা কি ভেবে দেখেছি?