আন্তর্জাতিক
নব্য ‘উজবুকদের’ দেশ মালদ্বীপ
প্রথমেই সম্মানিত পাঠকদের মস্তিষ্ক সতেজ করার চেষ্টা করব, যা আমি বরবারই করে থাকি। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির (সংক্ষেপে বখতিয়ার খলজি) কথা অপনাদের নিশ্চয় মনে আছে। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কে ‘মধ্যযুগের বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। এই ১৩ শতকের শুরুতেই বখতিয়ার খলজি বাংলার উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাংশের সেন শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুসলমান শাসনের সূচনা করেন।
এখন আসি একটা ভাইটাল প্রশ্নে। প্রশ্নটি হলো : ‘উজবুক’-এর অর্থ কী? কাহাকে বলে এবং কত প্রকার ও কী কী?
প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার আগে উজবেকিস্তান নিয়ে কিছু বলব। উজবেকিস্তান হলো মধ্য এশিয়ার একটি দেশ, যাকে বলা হয় ‘ডাবল ল্যান্ড-লকড’ দেশ। যার অর্থ হলো, নিজেও ল্যান্ড-লকড (স্থলবেষ্টিত), আবার আশপাশের সব দেশই ‘ল্যান্ড-লকড’। এই হলো বর্তমান স্বাধীন রাষ্ট্র উজবেকিস্তানের অবস্থা।
ঘটনা হলো, মধ্যযুগে বখতিয়ার খলজি যুদ্ধের প্রয়োজনে হালের এই উজবেকিস্তান থেকে কিছু ভাড়াটিয়া সৈন্য এনেছিলেন, যাদের এককথায় বলা হতো ‘উজবুক’। পরে তারাই বাঙালিদের কাছে উজবুক হয়ে ওঠেন। আর ‘উজবুক’ শব্দটির অর্থ হয়ে দাঁড়ায়—আহম্মক, মূর্খ, বোকা, আনাড়ি, অশিক্ষিত ইত্যাদি।
'উজবুক' শব্দের অর্থ কী কারণেই বা এমনটি হলো? ইতিহাস সাক্ষী দেয় উজবুকদের দৈহিক শক্তির খ্যাতি ছিল প্রবল, কিন্তু মানসিক উৎকর্ষের খ্যাতি ছিল না। এই সৈন্যরা প্রচণ্ড শক্তিশালী হলেও খুব নির্বোধ ছিল। সে থেকে ‘উজবুক’ শব্দটি ‘আহম্মক’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে বাংলা অভিধানে স্থান করে নেয়। এ হলো অবস্থা।
এবার মালদ্বীপ নিয়ে আসা যাক। মালদ্বীপ একটি ছোট রাষ্ট্র, যার আয়তন ১১৫ বর্গমাইল। কিন্তু মালদ্বীপ উজবেকিস্তানের মতো ল্যান্ড-লকড দেশ নয়। মালদ্বীপ ভারত মহাসাগরে অবস্থিত। চারদিকে সমুদ্র।
মালদ্বীপ দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপ দেশ। ভারতের দক্ষিণে ভারত থেকে দুই হাজার ১৪২ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই দ্বীপদেশে ২৬টির মতো উপহ্রদ বেষ্টনকারী বৃত্তাকার প্রবাল প্রাচীর রয়েছে, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় 'আটোল' I
১৯৭০ সাল পর্যন্ত মালদ্বীপকে একটি পর্যটন রাষ্ট্র হিসেবে কেউ চিনত না। সেই থেকে শুরু। বর্তমানে ৯০ শতাংশের বেশি সরকারি ট্যাক্স রেভিনিউ পর্যটন খাত থেকে আসে। বর্তমানে বছরে ছয় লাখের বেশি পর্যটক মালদ্বীপ ভ্রমণ করেন। ১৯৭২ সালে যেখানে রিসোর্ট ছিল দুটি, সেখানে বর্তমানে রিসোর্টের সংখ্যা প্রায় ৯২টি। বাংলাদেশের প্রায় ৮০ হাজার শ্রমিক মালদ্বীপে চাকরি করে। ১৯৭৮ সাল থেকে আমরা মালদ্বীপের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছি।
এই ছোট্ট একটি দেশ। সেখানেও কত রাজনীতি। মালদ্বীপ এখন পরিষ্কারভাবে দুটি পন্থীতে বিভক্ত। একদল ভারতপন্থী, অন্যদল চীনপন্থী।
মামুন আবদুল গাইউম ১৯৭৮ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ৩০ বছর মালদ্বীপ শাসন করেছেন। তাঁর আমলেই ১৯৮০, ১৯৮৩ ও১৯৮৮ সালে তিনটি ক্যু হয়। ৩ নভেম্বর ১৯৮৮ সালে ভারতীয় সৈন্যরা ২৬ হাজার সৈন্য নিয়ে মালদ্বীপ প্রবেশ করে। ‘অপারেশন ক্যাকটাস’খ্যাত এই অপারেশন দুই বছর ধরে চলে। সেই থেকে ভারতের সঙ্গে মালদ্বীপের সম্পর্ক শুরু হয়।
তার পর আসে মোহাম্মদ নাশিদের যুগ (২০০৮-০৯)I তিনিও ছিলেন ভারতপন্থী। মালদ্বীপের সর্বপ্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিল নাশিদ। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১২ সালে তিনি পদত্যাগ করেন এবং শ্রীলঙ্কা নির্বাসনে চলে যান।
তারপর ২০১৩ সাল থেকে ক্ষমতায় আসেন আবদুল্লাহ ইয়ামিন। কিন্তু তিনি হয়ে গেলেন চীনপন্থী। ২০১৩ সাল থেকেই চীন ও ভারত এ উভয় দেশ মালদ্বীপের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বর্তমানে এগিয়ে আছে চীন। ২০০৯ সাল থেকেই কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে মালদ্বীপে চীনের প্রভাববলয় সৃষ্টি হয়েছে।
ভারতের মাথা তো ঠিক থাকার কথা নয়। পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান সবকটি দেশই এখন চীনের বলয়ে। একমাত্র বাংলাদেশকে ভারত আপাতত ‘পাশে আছে’ বলে মনে হলেও সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের মিয়ানমারের প্রতি সমর্থন বাংলাদেশের মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে।
ছোট একটি দেশ মালদ্বীপ সুখে-শান্তিতে ভালোই চলছিল। এখন চীন ও ভারতের শ্যোন দৃষ্টি পড়েছে দেশটির ওপর। চলছে রাজনৈতিক সংঘাত। চলছে জরুরি অবস্থা। এরই মধ্যে নাশিদ শ্রীলঙ্কায় বসে বসে ভারতকে আহ্বান করছে, ১৯৮৮ সালের মতো ভারত যেন মালদ্বীপের ওপর সামরিক হস্তক্ষেপ করে।
একটি দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কেমন করে দেশটিকে রসাতলে নিতে পারে, মালদ্বীপ হলো তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অনেকটা সুখে থাকলে ভূতে কিলানোর মতো। অন্যের বলয়ে থেকে নিজের ক্ষমতা পোক্ত করার কাজে সব নেতাই লিপ্ত। এমনকি এ কাজে শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ তারাও পেছনে নেই। বিচার বিভাগবিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের জেল থেকে ছেড়ে দিয়ে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ করে দিয়ে সরকার পতনের খেলা খেলেছে। আবার সরকারও তাদের জেলে দিয়ে নিজের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার পাঁয়তারা করেছে। এ হলো মালদ্বীপের সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক চিত্র।
এ যেন এক নব্য ‘উজবুকদের’ দেশ, যারা নিজের দেশটিকে অন্যের সহায়তায় রক্ষা করতে চাচ্ছে। গায়ে অনেক শক্তি, কিন্তু মাথা কাজ করেন। মালদ্বীপ ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সের সংখ্যা মাত্র পাঁচ হাজারের মতো। এদিকে রাজনৈতিক নেতাদের কোনো লক্ষ্য নেই। হয়তো ভারত, না হয় চীন আসবে বিপদে-আপদে। এটা নিঃসন্দেহে একটি 'উজবুকিও' মানসিকতা।
লেখক : সাবেক সেনা কর্মকর্তা, বর্তমানে এআইবিএ, সিলেটে কর্মরত।