সিরিয়া
‘ঘৌতা’র ক্রুরতা ও ‘সংঘে’র ভণ্ডামি
সোমবার গণমাধ্যমে সিরিয়ার ঘৌতা শহরের গলি-ঘুপচির একটি ছবি দেখলাম। বিদেশি গণমাধ্যম রয়টার্সের সে ছবি স্থির। কিন্তু ছবির মানুষরা এতটাই জীবন্ত যে রক্ত-মাংসের মানুষমাত্রই তাঁদের অনুভব করতে পারবেন; তাঁদের ব্যথাতুর নিশ্বাস শুনতে পাবেন; কিংবা তাঁদের গগনবিদারী চিৎকারও শুনতে পাবেন চাইলে। ছবিটি এক বাবা আর তাঁর কোলে তিন-চার বছর বয়সী শিশুকন্যার। ছবির শিশুটির আর্তচিৎকারে যেমন হাঁ হয়ে আছে ছোট্ট মুখখানি, তেমনি ভয়ে আর আতঙ্কে চিৎকার করে কাঁদতে থাকা বাবার মুখটাও পুরোটাই হাঁ হয়ে আছে। কে কাকে অভয় দেবে? কোমলমতি শিশু নাকি বিচক্ষণ বাবা! ঘটনা এমন, দুজনই সমান আতঙ্কিত। দুজনই দৌড়াচ্ছে প্রাণভয়ে।
ঘৌতা শহরজুড়ে এখন এমন সব ছবিই পাওয়া যাবে। যদিও সেসব ছবির কয়টা আমরা দেখতে পাব, তা নিয়েও আছে সংশয়। কজন বাবার কোলে এমন শিশুরা এখনো জীবিত আছে, তা-ও তো একটা ভাবনার বিষয়। কেননা, রয়টার্সেরই আরেকটি ছবি দেখলাম। যেখানে বাবার কোলে শুয়ে আছে ৮-১০ বছরের এক ছেলেশিশু। বাবা ছুটছেন হয়তো কোনো অ্যাম্বুলেন্স কিংবা হাসপাতালের খোঁজে। কিন্তু ছবিতে নুয়ে পড়া কোমল দুটি হাত বলছে, স্কুলের পোশাক পরা এই শিশুটির ছোট্ট দেহে আসলে আর প্রাণ নেই। তার গায়ে স্প্লিন্টারের অসংখ্য ক্ষত। ছোপ ছোপ লাল রক্ত সেখানে জমা হয়ে আছে বিন্দু বিন্দু। কিন্তু বাবা কি তা বুঝবে?
সিরিয়ার ঘৌতা শহরের বাবারা আর মায়েরা এখন সম্ভবত মৃত্যুর পরের বেহেশত বা দোজখের হিসাব করা ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ, পৃথিবীর মধ্যেই একটা আস্ত দোজখে এখন আছেন তাঁরা। এই নরক যন্ত্রণা থেকে এখন তাঁরা কেবল তাঁদের বাচ্চাদের একটুখানি রেহাই দিতে চাইছেন। কিন্তু তাও পারছেন না। কেউ কেউ মাটি খুঁড়ে অন্ধকার গুহাও বানিয়েছেন। কিন্তু শোনা যাচ্ছে, এ যুগের ইবলিস শয়তানরা রাসায়নিক বোমা নামের গ্যাস ছেড়ে দিয়েছে সেখানকার বাতাসে। সে বাতাস ঢুকে যাচ্ছে ইট-কংক্রিট আর মাটি ভেদ করে গোপন গুহায়। গ্যাসে খসে পড়ছে সেখানকার শিশু ও বৃদ্ধদের গায়ের চামড়া। তারা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, কিন্তু উপসম হচ্ছে না!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্নায়ুযুদ্ধের খলনায়করা সবচেয়ে বেশি তৎপর এই মুহূর্তে সিরিয়ার এই ছোট্ট শহরটিতে। গোটা মধ্যপ্রাচ্যে, ইরাক-লিবিয়া-সিরিয়া-ইয়েমেন, রক্তের হোলি খেলায় মেতে ওঠা এই খলনায়করা কে কার চেয়ে বড়, কে কার চেয়ে খতরনাক হতে পারে, তার প্রমাণে উঠেপড়ে লেগেছে এই একখণ্ড ভূমিতে। সেখানে কি মনুষ্য প্রজাতির কেউ থাকে, নাকি জন্তু-জানোয়ার বসবাস করে, তা দেখার সময় তাদের নেই। কিংবা মাটির পরিবর্তে ওই মাটির ঔরসজাতদের আপাতত বনের জানোয়াররূপে গণ্য করতেও তাদের কোনো দ্বিধা নেই। তাদের চাই জমি। একবিংশ শতাব্দীর জোতদার শ্রেণির অভিজাত লোক তারা। তাদের শুধু জমি চাই, এক টুকরো জমি। এ জন্য চাই তো গোটা পৃথিবীর অস্ত্রসম্ভার এখানে ঢেলে দেওয়া হবে। পৃথিবীর যত সেরা বোমারু বিমান আছে, তা এখানে বোম্বিং করবে, পৃথিবীর সবচেয়ে নিপুণ নিশানা ভেদকারী বিমান এখানে বোমা ফেলবে। প্রয়োজনে সবচেয়ে ভারী ট্যাঙ্ক এখানে চষে বেড়াবে। যেকোনো উপায়ে সব মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। তবু শত্রুকে বোঝানো চাই, পৃথিবীতে আমিই সেরা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর শক্তিধর অস্ত্রবাজরা পৃথিবীর মানুষকে বোকা বানাতে একটা সংঘ করেছে। বলেছে, দুর্বল প্রজাতির যত জাতিগোষ্ঠী আছে, তাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। পৃথিবীতে যেন আর যুদ্ধ না হয়, যেন সর্বত্র শান্তি বিরাজ করে, সে জন্য কাজ করবে এই বিশেষ সংঘ। যদিও এ মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্বল জাতিগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় এই সংঘ আজ পর্যন্ত কিছুই করতে পারেনি।
‘জাতিসংঘ’ নামক মহান এই সংঘ লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে রোববার একটা বিরতির কথা মুরুব্বিদের বলেছে। কিন্তু এক মুরুব্বি কিছুটা আমতা আমতা করলেও আরেক মুরুব্বি তাকে ধমক দিয়ে বলেছে, ‘চুপ রাও, এখন বিরতির সময় নাই, এখন বিজয়ের সময়’! সে এসব বিরতি-টিরতি মানবে না। মানছে ও না। তার পেটে জমির ক্ষুধা। জমি উদ্ধারে সে তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে।
বিশ্বগণমাধ্যম বলছে, গত কয়েক দিনে সিরিয়ার ঘৌতা শহরে একটানা বোম্বিং করেছে রাশিয়া সমর্থিত আসাদ সরকারের বাহিনী। এই অতর্কিত আক্রমণে এরই মধ্যে বেঘোরে মারা পড়েছে শত শত নিরীহ মানুষ। যার একটা বড় অংশই হলো শিশু। ভিডিওতে দেখা গেছে, সেখানে এমনকি পলায়নপর সাধারণ মানুষের ওপরও বোমা ফেলা হচ্ছে।
রাস্তায় রাস্তায় বোমার স্প্লিন্টার, ধুলো আর ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে চারপাশ অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। বোমা পড়ছে বসতবাড়ি, হাসপাতাল, স্কুল সর্বত্র। কোনো বাছবিচার নেই। চারদিকে শুধু মৃত্যু আর মৃত্যু। প্রায় চার লাখ মানুষের শহর পরিণত হয়েছে আস্ত একটা মৃত্যুপুরীতে। পরিস্থিতি এমন, এ শহর থেকে পালিয়ে যাওয়ারও কোনো উপায় নেই বাসিন্দাদের।
নিরীহ মানুষদের অন্তত পালানোর সুযোগ করে দিতে এবং খাদ্য ও পানীয় পৌঁছে দিতে নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বোমার আঘাত থেমে নেই। কিছুটা রাখঢাক করলেও বোঝাই যাচ্ছে, রাশিয়া সরাসরিই অংশ নিচ্ছে এই ছায়াযুদ্ধে। আর নিরাপত্তা পরিষদকে থোড়াই কেয়ার করাও নতুন কিছু নয়।
সিরিয়ার আসাদ সরকার ও রাশিয়া চাইছে, যেকোনো উপায়ে ঘৌতা শহরকে দখল করতে। কারণ দেশটির রাজধানীর অতিনিকটে অবস্থিত এই শহরটিই নাকি বিদ্রোহীদের হাতে থাকা সর্বশেষ শক্ত ঘাঁটি। এ জন্য পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেছে এই পক্ষ। সেখানে কে মারা গেল আর কে বেঁচে থাকল, এই হিসাব করার সময় নেই তাদের। জাতিসংঘ মহাসচিব এই শহরের পরিস্থিতিকে বলেছেন পৃথিবীর মধ্যে ‘নরক’। ওই বলা পর্যন্তই। এই নরক থেকে সেখানকার বাসিন্দাদের রক্ষায় তিনি বা তাঁর সংঘ আর কিছুই করতে পারছেন না।
বিশ্বব্যাপী শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের অঙ্গীকার নিয়ে চালিত হলেও জাতিসংঘ যে আসলে দিন দিন একটা ঠুঁটো জগন্নাথে রূপ নিচ্ছে, তা এ মুহূর্তেই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি করে বোঝা যায়। বোঝা গেছে রোহিঙ্গা নিপীড়নের সময়েও। একদিকে নিপীড়িত মানুষের আর্তচিৎকার, অন্যদিকে এই ‘সংঘে’র কেবল চেয়ে চেয়ে দেখা। এর চেয়ে লজ্জাকর, এর চেয়ে দীনতা আর কী হতে পারে! ঘৌতার অন্ধকার গলিতে বোমার আঘাতে কাতর শিশুকে এক চুমুক পানি বা একটি ব্যান্ডেজ পৌঁছে দিতে না পারার ব্যর্থতা এই সংঘের ললাটে নিশ্চিতভাবেই কলঙ্কের চিহ্ন এঁকে দিচ্ছে।
পৃথিবীর তাবৎ অপশক্তি জড়ো হয়েছে সিরিয়ার মাটিতে। সেখানে তারা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা খেলছে বছরের পর বছর। সে দেশের প্রতিটি শহর আজ পরিণত হয়েছে একেকটা বৃহদাকার ধ্বংসস্তূপে। কিন্তু জাতিসংঘ কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছে না সেখানে। বস্তুত তার কথা কেউ শুনছে না সেখানে। এবং যা একটু আগে বললাম, জাতিসংঘ যে একটা ঠুঁটো জগন্নাথ এবং পরাশক্তিদের একটা ক্রীড়নক হয়ে উঠছে, তাও প্রমাণিত সত্য হিসেবে দেখা দিয়েছে এই সিরিয় যুদ্ধে।
কথা হলো, সংঘের নামে এই ভণ্ডামি আর কত দিন? কত দিন পৃথিবীর নিরীহ নির্যাতিত মানুষেরা কেবল লোভী আর হিংস্র মানুষদের এমন ক্রুরতার শিকার হবে আর জাতিসংঘ চেয়ে চেয়ে দেখবে? যদি কিছুই করতে না পারল, তবে জাতিসংঘ নাম পরিবর্তন করে ‘পরাশক্তিদের নিজস্ব সংঘ’ হিসেবে নতুন করে পরিচয় প্রদান করা হোক। তাতে অন্তত নির্যাতিত মানুষ ‘আশার ছলনে ভুলিবে’ না।
লেখক : সাংবাদিক, আরটিভি।