সালমান খানের কারাদণ্ড, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উক্তি ও কিছু কথা
১৯৯৮ সালের ২ অক্টোবর ভারতের রাজস্থানে সিনেমার শুটিং করতে গিয়ে দু’টি কৃষ্ণসার (এন্টিলোপ) হরিণ হত্যার দায়ে যোধপুরের একটি আদালত ভারতীয় ফ্লিমস্টার সালমান খানকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনের যে ৯(৫১) ধারা সেই ধারার মাধ্যমেই সালমানকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং এ ধারার মাধ্যমে দোষী সাবস্ত্য হয়ে তিন বছর জেল হলে নিম্ম আদালতেই জামিনের ব্যবস্থা থাকেন। কিন্তু সালমানকে পাঁচ বছর কারদণ্ড দেওয়ার ফলে এখন তাঁকে উচ্চ আদালতে যেতে হবে জামিনের জন্য। এর মাধ্যমে ভারতে সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিকভাবে আধিপত্য রয়েছে এমন ব্যক্তিরাও যে জেলে যাবে এটাই নিশ্চিত করল ভারতীয় আইনব্যবস্থা। যা সত্যিই সাধুবাদের যোগ্যতা রাখে।
কিন্তু বিষয়টা সেখানে নয়, বিষয়টা অন্যখানে। কারণ, এই রায়ের জের ধরে দেশের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। সবাই এটাকে ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেছে। এমনকি এই হরিণ বাঁচিয়ে রাখতে যে বিষ্ণোই সম্প্রদায় সবসময় সচেষ্ট; তারাও রায় শোনার পর আদালতের সামনে স্লোগান দেয় এবং উল্লাস প্রকাশ করে।
কিন্তু প্রতিক্রিয়াটা এসেছে পাশের দেশ পাকিস্তান থেকে, যাদের সাথে ভারতের সম্পর্ক এখন ভালো যাচ্ছে না, সীমান্ত অঞ্চল নিয়ে বিরোধসহ দুই দেশের বৈদেশিক নীতির দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়। পাকিস্তানের জিও টিভির এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খাজা আসিফ আব্বাস বলেছেন যে, “সালমান খান সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন, কারণ ভারতে তিনি সংখ্যালঘু। ভারতে বসবাসরত মুসলিম, অচ্ছুৎ বা খ্রিস্টানরা যে মূল্যহীন এবং তারা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তা ২০ বছর আগের এই মামলার বিচার দেখেই বোঝা যায়।”
খাজা আসিফ আব্বাস যে বিষয়টা বলেছেন তা সত্যিই অযৌক্তিক। কারণ তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে ধরনের মতামত ব্যক্ত করেছেন তা করা প্রথমেই তাঁর উচিৎ নয়, এক্তিয়ারের বাইরে। কারণ একটি দেশের আভ্যন্তরিক বিষয় নিয়ে আরেক দেশের সাধারণ মানুষই কথা বলতে পারে না। সেখানে একটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি প্রধানমন্ত্রীর পর সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত, তিনি এ কথা কোনোভাবেই বলতে পারেন না। কারণ ম্যাকিয়াভেলির ‘প্রিন্স’ বা চাণক্যের ‘অর্থসূত্র’ পাঠ করার পরও আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি না যে এমন উক্তি একটি দেশ আরেকটি দেশ সম্পর্কে করতে পারে। তাই পাকিস্তানের মতো একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তাঁর উচিত হয়নি এমন কথা বলা।
সবচেয়ে বড় বিষয় যেটি তা হলো এ মামালাতে যে শুধুমাত্র সালমান খান ছিলেন তেমন কিন্তু নয়। এরই সাথে অভিযুক্ত ছিলেন সাইফ আলী খান। তাহলে পাকিস্তান মন্ত্রীর হিসেবে বলতে হয় সাইফ আলী খান ছিলেন হিন্দু না হলে ভারতীয় আদালত তাঁকে খালাস দিলেন কেন? প্রশ্নটা যে আসতে পারে এমনটা ভাবেননি খাজা আসিফ আব্বাস। এবং আসলেই তিনি জানেন কি না জানি না, যে সাইফ আলী খানও এ মামলার একজন আসামি ছিলেন এবং তাঁকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে আরেকটা উদাহরণ আনা যায়, ভারতীয় অভিনেতা সঞ্জয় দত্তের। সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক দিক দিয়ে সঞ্জয় দত্তের প্রভাবও ভারতে কম নয়। এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী খাজা আসিফ আব্বাসের মতের সাথে মিল রেখে বলতে হয়, সঞ্জয় দত্ত মুসলমান নয়, তাই তাঁরও তো উচিত ছিল জেলের বাইরে থাকা। কিন্তু ১৯৯৩ সালে মুম্বায়ে ব্লাস্টের সময় অবৈধ অস্ত্র বহনের দায়ে সঞ্জয় দত্ত জেল খাটছেন। কী বলবেন খাজা আসিফ আব্বাস এ ব্যাপারে? তিনি যদি বলেন যে সংখ্যালঘু হিসেবে সালমান খানের ওপর এমন অবিচার করা হয়েছে, তাহলে সঞ্জয় দত্তের বেলায় তিনি কী বলবেন? প্রশ্ন রয়েই যায়।
আর একটা বিষয়ের আলোচনা করা যেতে পারে। যেমন ‘এক থা টাইগার’ বা ‘টাইগার জিন্দা হে’ সিনেমা কেন পাকিস্তানে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল? কারণ কি ছিল এটাই যে সালমান খান ভারতে সংখ্যালঘু? এ প্রশ্নের কী জবাব দিবেন পাকিস্তানের প্রররাষ্ট্রমন্ত্রী? কোনো জাবাবই যে তিনি দিতে পারবেন না, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।
এটিই যে সালমান খানের বিরুদ্ধে করা প্রথম প্রাণী হত্যার অভিযোগ তা নয়, এর আগেও দুটি মামলায় তাঁকে দোষী সাব্যাস্ত করা হয়। এবং বিশেষ বিবেচনাতে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়। তা ছাড়া মদ্যপ অবস্থায় মুম্বাইয়ের রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে গরিব মানুষ মারা অভিযোগ থেকেও তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু এবার আর তাঁর মুক্তি মিলল না, সাজা হয়ে গেল। আর সেটাই উচিত হয়েছে।
সংখ্যালঘু নির্যাতন মানা যায় না, যাবে না। কিন্তু তারা যদি অপরাধ করে তা কি মেনে নিতে হবে? এটা কী করে সম্ভব। কারণ সবাই তো চাই একটি অভিযোগের সুষ্ঠু বিচার হোক। এ ক্ষেত্রে শোয়েব আখতার যে টুইট করেছেন, সেটাকে একটি যৌক্তিকাতার মধে ফেলা যায়। সালমান খানের বন্ধু শোয়েব আখতার বলেছেন যে, ‘বিষয়টা বেশ কষ্টের হলেও মহামান্য আদালতের রায় মেনে চলা উচিত।‘
সংখ্যালঘু হলে কি তার কোনো বিচার হবে না? সে কি বিচার ব্যবস্থার উপরে অবস্থান করা ব্যক্তি? যদি এমনটাই হয় তাহলে তো বিষয়টা অবশ্যই নিন্দনীয়। কারণ, সংখ্যালঘুর তকমা গায়ে এটে তো আর যে কেউ নিরন্তর অপরাধ করে যেতে পারে না। এটা কোনো একটি গণতান্ত্রিক এবং আইনের শাসন আছে এমন রাষ্ট্রে চলতে পারে না, চলা উচিৎ নয়। ফলে ভারতের সংখ্যালঘুদের উপর নিরন্তর অত্যাচার এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে সবসময় সরব থাকা উচিত, কিন্তু একজন সংখ্যালঘু অন্যায় করবে কিন্তু তার শাস্তি হবে না এটা অন্যায় এবং এই শাস্তির বিরুদ্ধে কথা বলা আরো অন্যায়, অনুচিত।
ফলে খাজা আসিফ আব্বাস যে মন্তব্য করেছে তা অবশ্যই নিন্দনীয়। যদি একটি যৌক্তিক কোনো ধরনের উক্তি খাজা আসিফ আব্বাস করতেন তা হলে সেটি মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু তিনি অন্য দেশের, যে দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা উচিত; কিন্তু নেই, আভ্যন্তরিক বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারেন না। আর সেটি ইতিবাচক উক্তি হলে ঠিক ছিল, কিন্তু সেটি অবশ্যই ইতিবাচক নয়, তা নেতিবাচক অবশ্যই এবং এই উক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রকৃত চেহারা আবার বের হয়ে আসল। পাকিস্তানে আদিম ইসলামিস্ট, গোঁড়ামি, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, বিচারহীনতার যে বাস্তবতা বিদ্যমান, তা প্রকাশিত হয়েছে খাজা আসিফ আব্বাসের উক্তির মধ্য দিয়ে।
আর একটি দেশের আভ্যন্তরিক বিষয় নিয়ে অন্য একটি দেশ কথা বললে স্বাভাবিকভাবেই সমস্যার সূত্রপাত হয়। এবং সামান্য এই বিষয়টার জন্যই দীর্ঘদিনের শান্তিচুক্তির পথ থেকে এক ধাপ পেছাল পাকিস্তান, বলাই যায়। আর এ দু’টি দেশের মধ্যে আগে থেকেই সমস্যা রয়েছে। ফলে জ্বলন্ত আুগুনে ঘি ঢালার মতো সমস্যাটি আরো যে দীর্ঘতর হবে তা বলতেই হবে। পাকিস্তান যে কাজটা করেছে, তা পাকিস্তান মোটেও ঠিক করেনি। এটি এ দুটো দেশের মধ্যে বিরাজমান সংকটকে আরো বৃদ্ধি করবে, সমাধানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।