অভিমত
পাকিস্তানে ইমরান খানের উত্থানের নেপথ্য
নির্বাচনের প্রায় এক বছর আগে থেকেই পাকিস্তানে জোর গুঞ্জন পাওয়া যাচ্ছিল, সেনাসমর্থিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ প্রধান ও সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান। সেই সূত্র ধরেই আজ ইমরানের সমর্থকরা বিজয়োল্লাসে মত্ত। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নির্বাচন সামনে রেখে এক বছর ধরে যা ঘটছে একে আরেকটি নীরব সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।
নির্বাচনে জয়ী হওয়ার ব্যাপারে ভোটের তিন মাস আগে থেকে সব রকম জরিপে নওয়াজ শরীফের দল এগিয়ে থাকলেও রাজনীতিতে ভিন্ন মেরুকরণ ঘটেছে। বিশেষ করে পাকিস্তানের চলতি ক্ষমতার পালাবদলের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান মুসলিম লিগের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে মন্তব্য করেছিল শক্তশালী গণমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস। প্রভাবশালী এই সংবাদমাধ্যমটির মন্তব্য, সেনাবাহিনীর দৃষ্টিতে নওয়াজ ক্ষমার অযোগ্য ভুল করেছেন। কারণ সেনা আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে নওয়াজ তিনবার প্রধানমন্ত্রী হলেও ক্ষমতাধর সেনা কর্তৃপক্ষকে তুষ্ট করতে পারেননি তিনি। এজন্য তিনবারই মেয়াদপূর্তির আগেই ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। সেনাবাহিনী যে তাঁকে আর সুযোগ দেবে না সেটা পরিষ্কার ছিল।
পাকিস্তানে এমন এক সময় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যখন দুর্নীতির দায়ে আদালতে অযোগ্য ঘোষিত হয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ। লন্ডনের ফ্ল্যাট ক্রয় সংক্রান্ত এক দুর্নীতির মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে দণ্ড ঘোষিত হয়েছে। মূলত ইমরানকে পেছন থেকে মদদ দিতে নওয়াজকে নির্বাচন পর্যন্ত কারাগারে রাখতে সে দেশের সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগ এক হয়ে কাজ করেছেন। অন্যদিকে এই অভিযোগের বিশেষ সমর্থন পাওয়া যায়, পাকিস্তান হাই কোর্টের এক বিচারকের কথায়; তিনি গত ২৩ জুলাই বলেছিলেন, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বিচার বিভাগের কাজেও হস্তক্ষেপ করছে।
বর্তমান সেনাপ্রধানের সঙ্গে বিশেষ বন্ধুত্ব ইমরানকে নির্বাচনে বিজয়ী হতে সহায়তা করেছে বলেই মনে হয়। ব্যাপক সহিংসতা, প্রাণহানি ও রেকর্ডসংখ্যক সেনাসদস্যের উপস্থিতি ছিল এই নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য। পাকিস্তানের এ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় আট লাখ সদস্য মোতায়েন থাকা সত্ত্বেও ভোট গ্রহণ শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বোমা বিস্ফোরণে ৩৩ জনের মৃত্যুর ঘটনা সাধারণদের শঙ্কিত করে তুলেছে। উল্লেখ্য, এর মধ্যে তিন লাখ ৭১ হাজার ৩৮৮ জন সেনাবাহিনীর সদস্য ছিল।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে নানাবিধ উত্থান-পতনের ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটে। ১৯৯৯ সালে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে উৎখাত হওয়ার পর তখনকার সেনাশাসক পারভেজ মোশাররফ নওয়াজকে ফাঁসিতে ঝোলাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সৌদি রাজ পরিবারের অনুগ্রহে সেবার রক্ষা পেয়েছিলেন। এরপর ২০১৩ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রীর শপথ নেওয়ার পর পরই নওয়াজ শরীফ বলেছিলেন, তিনি পাকিস্তানের মানুষকে জানিয়ে দিতে চান যে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি রাষ্ট্রের ‘বস’, সেনাবাহিনী নয়। মূলত তাঁর এই বক্তব্যেই নওয়াজ শরীফের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে পানামা পেপারস ফাঁসের পর নওয়াজের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া বর্তমান মামলাটি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ভাগ্যকে সুপ্রসন্ন করেছে। সেনাবাহিনীর ইশারাতেই সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ পাননি নওয়াজ। প্রথম দিকে সুপ্রিম কোর্ট নওয়াজের বিরুদ্ধে অপরাধের কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় পরবর্তী সময়ে তার আয়ের উৎস গোপন করার একটি তুচ্ছ অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। নওয়াজের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে সেনাবাহিনীর ইশারাতেই যে সুপ্রিম কোর্ট কাজ করেছেন, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই বললেই চলে। নওয়াজের মূল অপরাধ ছিল সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক ভাগ্যকে চ্যালেঞ্জ করা। আর এ কারণেই নওয়াজ শরীফকে ক্ষমতা থেকে সরানোর পদক্ষেপ হিসেবে সেনাবাহিনী ব্যবহার করেছে চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের।
গত তিন বছরে ভারত ও আফগানিস্তানে চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের মূলধারার রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেছে সেনাবাহিনী। ২০০৮ সালে ভারতের মুম্বাইয়ের তাজ হোটেলে জঙ্গি আক্রমণের প্রধান আসামি মাওলানা হাফিজ সাঈদকে শুধু মুক্তিই দেওয়া হয়নি, তাঁর নেতৃত্বে ‘আল্লাহু আকবার তেহরিক’ নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন খুলে সেই দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়েছে।
আর এসব প্রেক্ষাপটের ভিত্তি প্রস্তরের ওপরই ইমরান খানকে ক্ষমতায় আনার ছিল শুধু সময় গোনা এবং ক্ষেত্র প্রস্তুতের পালা। যথাযথভাবে ক্ষেত্র প্রস্তুত করেই আজ ইমরানের আগমন ঘটালেন সেনাবাহিনী। এর ফলে দেশটির গণতন্ত্রকামী শক্তিগুলো এই ইসলামীকরণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে স্পষ্টত ধারণা করা যায়।
সেনাবাহিনীর নতুন এই ছকে পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থার এই নতুন সংস্করণে উগ্র ইসলামি দল যেমন, লস্কর-ই-তৈয়বা, আল কায়েদা, জইশ-ই-মোহাম্মদ ও তালেবান গোষ্ঠী আরো শক্তিশালী হবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়। তাই সবকিছু মিলে মনে হচ্ছে পাকিস্তান ভবিষ্যতে আরো সামরিকতন্ত্র ও উগ্রবাদের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। কারণ সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান তাঁর প্রায় দুই দশকের রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই উগ্রপন্থী হিসেবে পরিচিত। ভাষা ও বক্তব্য মিলিয়ে পাকিস্তানে তাঁকে উগ্রপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। নওয়াজ শরীফ ও বিলওয়াল ভুট্টোকে পোষ মানাতে না পেরে পাকিস্তানের সেনা কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত অস্ত্র মনে করছে ইমরান খানকেই।
লেখক : ড. সুলতান মাহমুদ রানা, সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্রফেশনাল স্টাডিজ।